আরব বসন্তের সূচনাকারী ছিলেন তিউনিসিয়ার এক হতদরিদ্র মেধাবী তরুণ

ইতিহাস ও শিক্ষা
আরব বসন্তের সূচনাকারী ছিলেন তিউনিসিয়ার এক হতদরিদ্র মেধাবী তরুণ মোহাম্মদ বুয়াজিজি।
===============================
স্নাতক পাস করে বুয়াজিজি তার দেশের চরম অর্থনৈতিক মন্দা ও সীমাহীন দুর্নীতিপরায়ণ সরকার ব্যবস্থায় অনেক দিন ঘুরেও কোনো চাকরি পেলেননা। শেষ পর্যন্ত বাধ্য হয়ে স্থানীয় বাজারে সবজি বিক্রি শুরু করেন।

তাকে নিয়মিতই চড়া হারে কর্তৃপক্ষ ও পুলিশকে ঘুষ দিতে হত । নিরুপায় হয়ে তিনি এর সাথে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছিলেন । মা আর পাঁচ ভাই বোনের সবার খরচটাও তাকেই চালাতে হত । এত টানাটানির মাঝেও এই অসম্ভব হৃদয়বান ও পরোপকারী মানুষটি আত্মীয় স্বজন, পাড়া- পড়শি আর বন্ধুবান্ধবদের খেয়ে না খেয়ে সাহায্য করতেন । এজন্য তিনি এলাকার বাসিন্দাদের মধ্যে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় ।

নানা কারণে তাকে টাকা-পয়সার চরম সংকটের মাঝে দিয়ে যেতে হচ্ছিল, ফলে শেষে লজ্জার মাথা খেয়ে বেশকিছু টাকা ধার করতে হয়েছিল পরিবারকে বাঁচানোর জন্য (২০০ ডলার = ১৬,০০০ টাকা)। এতে করে কিছুদিনের জন্য  পুলিশের ধার্যকৃত ঘুষের টাকা বাকি পড়ে যায়।

২০১০ সালের ডিসেম্বরের ১৭ তারিখ এক সকালে তিউনিশিয়ার ছোট শহর সিদি বাওজিদে ঠেলাগাড়িতে করে ফল বিক্রি করছিলেন বুয়াজিজি। পৌরসভার মহিলা পুলিশ ইন্সপেক্টর ফাইদা হামদির ঘুষের টাকা চাইলে তা দিতে না পারায় সবার সামনে বুয়াজিজির মুখে একের পর এক চড় মেরে থুতু দেয়া হয় । অনবরত মাফ চাইতে থাকার পরও পুলিশরা হিংস্র পশুর মত দল বেঁধে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ঘুষি ও লাথি মেরে তাকে রক্তাক্ত আহত করতে থাকে ।

এই দৃশ্য চারপাশে থেকে নীরবে দেখলেও পাবলিকের কেউ টুঁ শব্দটিও করতে সাহস পায়নি । এক পর্যায়ে ইন্সপেক্টর বুয়াজিজি’র সকল মালামাল ঠেলা গাড়িটিসহ আটক করে নিয়ে যায়। রক্তাক্ত বুয়াজিজি হাতে পায়ে ধরে অনেক কাতর অনুনয় বিনয় করে তার মালামালসহ ফলের গাড়িটি ফেরত পাওয়ার জন্য। কিন্তু তাতে মন গলেনি নগর কর্তৃপক্ষের।

দিনের পর দিন এজন্য সরকারি অফিসে যেয়ে উপেক্ষা, অপমান, তাচ্ছিল্য সয়ে শেষে প্রাদেশিক গভর্ণরের অফিসে যান বুয়াজিজি । দিনের পর দিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টার পরেও অখ্যাত  অজ্ঞাত অতি তুচ্ছ বুয়াজিজির সাথে দেখা দেননি গভর্ণর। করবেনই বা কেন? কোথাকার কোন বুয়াজিজি তো আর ওনার মত এত চরম ব্যস্ত ও বিরাট গুরুত্বপূর্ণ মানুষের সময় দেবার মত কেউ না।

তিনি অন্য নেতাদের মারফত গভর্নরের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু ওনারাও ছিলেন "ভয়ানক ব্যস্ত"। জনৈক বুয়াজিজির জন্য কারোরই সময় হলো না।

এদিকে তার পরিবারের কাছে কয়দিন হল খাবার টাকাও নেই । মানুষের কাছে আর কত হাত পাতা যায়।

শেষমেষ মরিয়া বুয়াজিজি বাজার থেকে জ্বালানি তেল কিনে সরকারি ভবনের গেটের সামনে এসে গভর্ণরের সাথে দেখা করতে না দিলে নিজেকে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবার হুমকি দেন ।

গভর্ণর অফিসের কেউ তার এই কথা পাত্তাই দিলনা। কারণ তার মত অতি সামান্য "পাগল ছাগলকে" পাত্তা দেয়ার কোন প্রয়োজন তাদের ছিল না।

চরম উপেক্ষা আর তাচ্ছিল্যের কারণে শোকে পাগল হয়ে শেষ পর্যন্ত নিজের গায়ে আগুন দিয়েই দিলেন তিনি । বুয়াজিজির হয়তো সেসময় মনে হয়েছিল তার মৃত্যুতে দুনিয়ার কারো কিছু আসবে যাবে না । যদিও তার মৃত্যুর পর সেই ধারণা ভুল প্রমাণিত করে তিউনিশিয়ার জনগণ ।

মৃত্যু -

১৮ দিন ধরে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ৪ জানুয়ারি মারা যান মোহাম্মদ বুয়াজিজি। তার মৃত্যুর খবরে আত্মীয় স্বজন, পাড়া- পড়শি, বন্ধুবান্ধব আর এলাকাবাসী চরম উত্তেজিত হয়ে পড়ে।

এটাকেও অবশ্য পুলিশ বা প্রশাসন কোন গুরুত্ব দেয়নি। কারণ জনৈক অখ্যাত "পাগলকে" নিয়ে এইসব উত্তেজনা এমন কিছুই না। এগুলো হয় আবার পাবলিক দুই দিন পর নিভেও যায়।

তবে অবাক করার মত বিষয় হচ্ছে সেই তুচ্ছ ও অখ্যাত  "পাগলের" জন্য গণজমায়েত বাড়তে বাড়তে একসময় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। পাবলিক সরকারী বিভিন্ন অফিস ও এমনকি এক পর্যায়ে একটি থানা পর্যন্ত আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয় ।

এই ঘটনা ছড়িয়ে পড়লে তিউনিসিয়ায় একের পর এক থানা আর নেতা ও কর্মকর্তাদের অফিসে রাগে ক্ষোভে পাগল হওয়া পাবলিকের হামলার ঘটনা শোনা যেতে থাকে । সেসব ঘটনা শুনে কিভাবে যেন আরো ঘটনা ক্রমাগত ঘটতে থাকে।

তখন সরকার থেকে খোঁজ খবর চেয়ে বলা হল - কে এই বুয়াজিজি ? ? ! !

ততক্ষণে সারা দেশে আকস্মিকভাবে জ্বলে ওঠে সরকারবিরোধী বিক্ষোভের আগুন। পরিস্থিতি চলে যায় পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

তিউনিসিয়ার উপেক্ষিত তরুণ আর সাধারণ জনগণের মাঝে ছড়িয়ে পড়ে ধর্মঘট, অবরোধ, পুলিশকে ঢিল ছোড়া, জায়গায় জায়গায় আগুন দেয়া, সরকারী সন্ত্রাসীদের সাথে মারপিট, ধাওয়া- ধাওয়ি আর নানান পদ্ধতিতে তীব্র সংঘর্ষ । শেষমেশ সেনাবাহিনী নামানো হলেও তারা জনগণের উপর গুলি চালাতে বা দমন করতে অনীহা দেখায় ।

বিপ্লব -

"Mr. Nobody" হিসেবে তাচ্ছিল্যকৃত মোহাম্মাদ বুয়াজিজির আত্তাহুতির পর পুরো দেশব্যাপী দাবানলের মত ছড়িয়ে পড়ে তীব্র সরকারবিরোধী বিক্ষোভ। মাত্র এক (১) মাসের মাথায় পতন ঘটে ২৩ বছরের স্বৈরশাসক প্রেসিডেন্ট জয়নাল আবেদিন বেন আলির, যিনি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ৬ টন (৬০০০ কেজি) সোনা কার্গো বিমানে নিয়ে  সৌদি আরবে আশ্রয় নিতে পালিয়ে যান। বিপ্লবের শিখা ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র মধ্যপ্রাচ্যে।

কখনো কখনো সীমাহীন অন্যায়, অবিচার এবং তুচ্ছ, ক্ষমতাহীন ও বুয়াজিজির মত অসহায় মানুষের চোখের  পানি আর রক্ত দিয়েও লেখা হয় পরিবর্তন ও বিপ্লবের ইতিহাস।

ইতিহাস সাক্ষী, মানুষ যখন অনেক চেষ্টা করেও, হাজার মাথা কুটেও কোথাও কোন বিচার পায়না, আইন হয়ে যায় রাজনৈতিক ক্ষমতার হাতের খেলনা আর সন্ত্রাসীদের সেবক, ঠিক তখনই সাধারণ মানুষজন নিজের হাতে আইন তুলে নেয়।

সেই অভাগার পুরো নাম -
তারেক আল-তায়েব মোহামেদ বুয়াজিজি (আরবী ভাষায়: ( محمد البوعزيزي‎) (Mohamed Bouazizi)(২৯শে মার্চ, ১৯৮৪ - ৪ঠা জানুয়ারি, ২০১১)

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফিচার কী? একটি সুন্দর ফিচার কিভাবে লিখবেন? উপাদান, বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ।

নির্বাচনঃ ধর্মের রাজনীতি, রাজনীতির ধর্ম।