প্রবাসে নারী শ্রমিকদের আত্মহত্যার ৭৬ শতাংশই ঘটেছে সৌদি আরবে





ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের মুন্নী আক্তারের বয়স ছিল মাত্র ২২ বছর। তিন বোনের মধ্যে সবার ছোট তিনি, বেড়ে ওঠেন নানাবাড়িতে। মায়ের চিকিৎসার খরচ ও পরিবারের অভাব ঘোচাতে গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে গত ১৮ জানুয়ারি পাড়ি দেন সৌদি আরবে। স্বপ্ন ছিল বিদেশে গিয়ে পরিবারকে একটু সচ্ছলতা দেয়া। কিন্তু সে স্বপ্ন মাত্র ছয়দিনের মাথায় ভেঙে যায়। ২৪ জানুয়ারি দেশে আসে মুন্নীর মরদেহ। ডেথ সার্টিফিকেট ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে লেখা ছিল—আত্মহত্যা করেছেন এ তরুণী।

বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছরই হাজার হাজার নারী কর্মী বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। বেশির ভাগই কাজ করেন গৃহকর্মী কিংবা গার্মেন্টস শ্রমিক হিসেবে। সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ওমান, জর্ডান ও লেবাননই তাদের প্রধান গন্তব্য।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) এবং ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে বিভিন্ন দেশে গেছেন ৩ লাখ ৪৭ হাজার ৪৯৩ নারী কর্মী। একই সময়ে দেশে এসেছে ৪১২ নারীর মরদেহ। এর মধ্যে আত্মহত্যার শিকার হয়েছেন ৮৪ অভিবাসী নারী। উদ্বেগজনক বিষয় হলো এসব আত্মহত্যার ৭৬ শতাংশ ঘটেছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরবে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশে পাঠানোর আগে নারী শ্রমিকদের মানসিক স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা এবং অধিকার সুরক্ষার বিষয়ে সচেতন করা জরুরি। পাশাপাশি গন্তব্য দেশে শ্রমিক সুরক্ষায় কঠোর নজরদারি ও কার্যকর চুক্তি বাস্তবায়ন না হলে এ ধরনের মৃত্যুর ঘটনা থামানো কখনই সম্ভব নয়।

ব্র্যাকের মাইগ্রেশন অ্যান্ড ইয়ুথ প্লাটফর্মের সহযোগী পরিচালক শরিফুল হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘বাংলাদেশ থেকে যেসব নারী বিদেশে কাজের জন্য যান তারা দেশে মানসিক ও শারীরিকভাবে এতটাই ঝড়-ঝাপটা সহ্য করেন যে তাদের আত্মহত্যা করার কথা নয়। ফলে তারা এমন কোনো ঘটনার মধ্য দিয়ে গেছেন যে আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই আমরা পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জেনেছি, মরদেহে শারীরিক নির্যাতনের চিহ্ন দেখেছেন। তারা কি আসলেই আত্মহত্যা করেন নাকি প্ররোচনা করা হয়েছে কিংবা আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয়েছে?’

নিয়োগকর্তাদের বিচার না হওয়ায় বিদেশে নারী কর্মীদের ওপর নির্যাতন-নিপীড়ন বাড়ছে বলে মনে করেন এ অভিবাসন ও শরণার্থী বিশেষজ্ঞ। শরিফুল হাসান বলেন, ‘মৃত্যুর ঘটনায় সংশ্লিষ্ট দেশের পুলিশের তদন্ত করা উচিত। তদন্ত করে দোষী সাব্যস্ত হলে বিচার করতে হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে কেউ বিচারের আওতায় আসছে না। যে কারণে বারবার এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। নির্যাতন, নিপীড়ন ও বেতন না পেলে বিষয়গুলো নিয়োগকারী দেশের সরকারকে দেখতে হবে। তাছাড়া সব কর্মীর কাছে মোবাইল ফোন থাকবে, যাতে সমস্যায় পড়লে তারা দূতাবাসে যোগাযোগ করতে পারেন। এছাড়া দূতাবাস থেকে ফোনে মাঝেমধ্যে নিয়োগকর্তার কাছে কর্মীর ব্যাপারে খোঁজখবর রাখতে হবে।’


তথ্য বলছে, প্রতি বছর প্রবাসী নারী শ্রমিকদের মৃত্যুর বড় একটি অংশ আত্মহত্যাজনিত। আর এসব ঘটনার বেশির ভাগই ঘটে সৌদি আরবে, যেখানে নারী শ্রমিকরা প্রায়ই শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন, একাকিত্ব এবং কর্মপরিবেশের চাপে ভেঙে পড়েন।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে উদ্বেগজনক চিত্র। গত সাড়ে চার বছরে বিদেশে কর্মরত শতাধিক বাংলাদেশী নারী শ্রমিক আত্মহত্যা করেছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘটনা ঘটেছে সৌদি আরবে। ২০২১ সালে বিভিন্ন দেশ থেকে ফেরত আসে ৪৯ নারী শ্রমিকের মরদেহ, যেখানে ৯ জন আত্মহত্যা করেন। আর আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে আটজন ছিলেন সৌদি আরবের ও একজন লেবাননের। ২০২২ সাল ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ। এ বছর দেশে ফেরত আসে রেকর্ড ১০৯ নারী শ্রমিকের মরদেহ। এর মধ্যে ৩৪ জন আত্মহত্যা করেন—২৫ জন সৌদি আরবে, ছয়জন জর্ডানে, দুজন ওমানে এবং মালয়েশিয়া ও লেবাননে একজন করে।

দেশে ২০২৩ সালে ফেরত আসে ১০১ নারী শ্রমিকের মরদেহ, যেখানে আত্মহত্যা করে মারা যান ২০ জন। এর মধ্যে সৌদি আরবে ১৩, সংযুক্ত আরব আমিরাতে তিন এবং জর্ডান, ওমান, মালয়েশিয়া ও মৌরিতানিয়ায় একজন করে আত্মহননের পথ বেছে নেন। ২০২৪ সালে দেশে ফেরত আসে ৯৫ নারী শ্রমিকের মরদেহ। এর মধ্যে আত্মহত্যা করে মারা যান ১৫ জন। আত্মহত্যাকারীদের মধ্যে ১২ জন সৌদি আরবে, দুজন জর্ডানে ও একজন কাতারে ছিলেন। চলতি বছরের ২০ জুলাই পর্যন্ত দেশে মরদেহ এসেছে ৫৮ নারী শ্রমিকের। এর মধ্যে ছয়জন আত্মহত্যা করেছেন। তারা সবাই সৌদি আরবে গৃহকর্মীর কাজে গিয়েছিলেন।

সৌদি আরবে যাওয়ার ছয়দিনের মাথায় আত্মহত্যা করা মুন্নী আক্তারের বোন সুক্কুরি বেগম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘নানাবাড়িতে আমরা তিন বোন বড় হইছি। বোনডারে অনেক কষ্ট করে পালছিলাম। আমার মা চোখে দেখে না; ডায়াবেটিস ও মানসিক সমস্যাও আছে। মায়ের চিকিৎসা করবে এ আশা নিয়ে মুন্নী বিদেশে গেছিল। কিন্তু যাওয়ার কদিনের মধ্যেই মৃত্যুর খবর পাই। সবশেষ যখন কথা হয় বলছিল—আমারে এখান থেকে নিয়া যাও। শুনছি আমার বোন নাকি গলায় ফাঁস দিয়া মারা গেছে। দেশে আসার পর নানাবাড়ির লোকজন লাশটা খুলতে দেয়নি। এয়ারপোর্ট থেকে কবরস্থানেই রাখা হইছে। ঘরেও নিতে দেয়নি তারা। শুধু চেহারা দেখছিলাম।’

বিদেশে যাওয়া নারী কর্মীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হন। তবে অনেক ক্ষেত্রেই ডেথ সার্টিফিকেট কিংবা ময়নাতদন্তে মৃত্যুর সঠিক কারণ উল্লেখ থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। বেসরকারি সংস্থা রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) ‘ডেথ অব ফিমেল মাইগ্র্যান্ট ওয়ার্কার্স ইন ডেস্টিনেশন কান্ট্রিজ’ শীর্ষক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশে আসা নারী কর্মীদের মরদেহের ৭৯ শতাংশই গৃহকর্মী। আর ডেথ সার্টিফিকেটে উল্লেখিত মৃত্যুর কারণ ৪৮ শতাংশ ক্ষেত্রেই পরিবার বিশ্বাস করে না।

গৃহকর্মীর কাজ নিয়ে চলতি বছর এপ্রিলে সৌদি আরবে যান আসমা আক্তার। তবে নির্যাতনের শিকার হয়ে চার মাসের মধ্যেই নিথর দেহে দেশে ফিরতে হয় তাকে। ডেথ সার্টিফিকেটে মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা লেখা থাকলেও পরিবারের দাবি, নির্যাতনের শিকার হয়ে আসমার মৃত্যু হয়েছে। আসমা আক্তারের ছেলে রেজাউল করিম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মা প্রায়ই বলতেন তাকে মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন করা হতো। ঠিকমতো খাবার দেয়া হতো না। সর্বশেষ যখন কথা হয় তখন ফোনে বলেছে, তাকে নাকি লোক এনে মারবে, এর আগেও এ রকম মারধর করেছে। এটাই হয়তো শেষ কথা, আর কথা নাও হতে পারে। এরপর শুনি তিনি মারা গেছেন। লাশ দেশে আসার পর আমি নিজ হাতে কফিন খুলে দেখেছি মাথায় আঘাতের চিহ্ন, গায়ে চাবুক বা পাগরির রশি দিয়ে আঘাত করা হয়েছে।’

গ্রামের দরিদ্র পরিবারগুলো সাধারণত উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে বা স্বজনদের সহায়তায় সন্তান কিংবা স্ত্রীদের বিদেশে পাঠায়। পরিবার ভেবে নেয়, তাদের পাঠানো অর্থে দূর হবে দারিদ্র্য। কিন্তু বাস্তবে অনেক নারী কর্মী বিদেশে গিয়ে পড়েন নিপীড়ন ও নিঃসঙ্গতার ফাঁদে। ভাষাগত অক্ষমতা, আইনি সহায়তার অভাব এবং কর্মস্থলে নির্যাতন তাদের জীবনকে করে তোলে অসহনীয়।

ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ডের মহাপরিচালক ব্যারিস্টার মো. গোলাম সরওয়ার ভূঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইনে রয়েছে কর্মীদের সুন্দর কর্মপরিবেশে থাকতে দিতে হবে। এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে পদক্ষেপ নিতে হবে। দুই দেশের মিউচুয়াল আলোচনা ছাড়া এ সমস্যার সমাধান সম্ভব নয়। নিয়োগের চুক্তিপত্রগুলো সঠিকভাবে করতে হবে।’

শ্রমিকদের মৃত্যুর বিষয়ে তিনি বলেন, ‘মৃত্যুর কারণ অনেক স্বজনরাই বিশ্বাস করে না। এখন যদি সরকারের পক্ষ থেকে নিয়োগকারী দেশকে বলা হয়, আমরা নিজ দেশে মরদেহ পুনরায় ময়নাতদন্ত করব; তাহলে হয়তো তারা কর্মী নেয়া বন্ধ করে দিতে পারে। এমন একটা শঙ্কা রয়েছে।’

প্রতিবেদনটি ৩০ আগস্ট ২০২৫ দৈনিক বণিক বার্তার প্রিন্ট ভার্সনে শেষ পাতায় প্রকাশিত হয়।

অনলাইন লিংক: https://bonikbarta.com/bangladesh/ZGSfq45qWEJqeqXe





মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফিচার কী? একটি সুন্দর ফিচার কিভাবে লিখবেন? উপাদান, বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ।

নির্বাচনঃ ধর্মের রাজনীতি, রাজনীতির ধর্ম।