কীর্তণখোলায় এক রাত্রি।
কীর্তণখোলায় এক রাত্রি।
মা। একটি মমতা,একটি আবেগ, একটি ভালবাসার নাম।নদীও আমার কাছে মায়ের মত।খাল বা নদী শব্দটি শুনলেই মনের স্কেচে ভেসে ওঠে এক মমতাময়ী নারীমূর্তি।
গোলাপশাহ মাজার থেকে খুরের ঠক ঠক শব্দ করে এগিয়ে চলছে ঘোড়ার গাড়ি।উদ্দেশ্য লঞ্চঘাট।ঘোড়ার গাড়ি,আহা কি রোমাঞ্চকর! বাতাসে চুলগুলো কাশফুলের মত উড়ছে।এমন ইট পাথুরের রাজ্যে বুক ভরে নিশ্বাস, আহা! দিন আজকে ভাল যাবে আমার। কিন্তু নিজের অজান্তেই ঘোড়ার গায়ে প্রতিটা আঘাতে আঘাতে হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল।মুখের দু’ চোয়ালের মাঝে লোহার একটা বেড়ি,সাথে লম্বা টানা রশি।এটাই গাড়ির নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র।রশিতে টান পড়ে ব্যাথা পেলেই ঘোড়া স্টপ।সভ্যতা আর ২০০ বছরের পুরানো ঐতিহ্যের দোহাই দিয়ে আমরা এক শোষণকে বাঁচিয়ে রেখেছি।চালককে জিজ্ঞেস করলাম,ভাই এই ঘোড়া দুটোই কি প্রতিদিন চালান? উত্তরে বলল:’হ মামা’।ততক্ষণে লঞ্চঘাট পৌঁছলাম।
ঘড়ির কাটা তখন ঠিক সন্ধ্যা ৭ টা।লঞ্চঘাটে পায়চারি করছি আর হকারদের বিভিন্ন কারসাজি দেখছি। টার্মিনালে দাড়িয়ে বুড়িগঙ্গা চারপাশে চোখ নামক সার্চলাইটটিকে এদিক ওদিক করছিলা।হঠাৎ চোখের সামনে অপ্রত্যাশিত প্রত্যশা ধর দিল। বুড়িগঙ্গার পানিতে চোখ রাখতেই দেখি লাল- সবুজ বাংলাদেশের জার্সি পড়া একটি ছেলে। বয়স ৮-৯ বছর হবে।অব্যবহার্য ভাঙা শোলা দিয়ে তৈরি দেড়-দু’হাতের একটি “শোলার নৌকা” বাইছে(৩ নং ছবিতে)।একজন আসন পেতে কোন রকম বসা যায় এমন। ও পানির খালি বোতল সংগ্রহ করছে।না, না, সত্যি বলতে ও জীবন সংগ্রাম করছে।জীবন বড়ই বিচিত্র।অপ্রয়োজনীয় জিনিসটাই কারো কারো বাঁচার জন্য প্রয়োজন হয়।
“কীর্তণখোলা ২” লঞ্চে উঠে পড়লাম। নয়টা বিশে বরিশালের জন্য নোঙর ছাড়ল। চাঁদনী রাতে আকাশের নিচে চারদিকে জলরাশি, মাঝখানে আমি।পানির বুকচিরে শোঁ শোঁ করে এগিয়ে চলছে ‘কীর্তণখোলা-২’।
রাতের বেলা নদীর পরিবেশটা হয়ে যায় আরও অন্য রকম ।রাতের সৌন্দর্য সব চেয়ে সুন্দর । স্পষ্ট শুনা যায় নদীর ডাকা ডাকি কলতান । মন সতেজ করে দেয় ।কিছুক্ষণ বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য্য আর রাতের ঢাকা দেখা।বড় বড় বিলবোর্ডের লাল সবুজ আলো যখন বুড়িগঙ্গার উপরে পড়ে মনে হয় যেন ঢেউয়ের তালে নৃত্যের ঝর্ণা বয়িয়ে দিচ্ছে।আলোর ছড়াছড়ি, বাহ! মন মুগ্ধকর।
লঞ্চের তিনতলায় উঠে ঠান্ডা হাওয়া গায়ে মাখা আর চাঁদের আলোয় নদীকে উপভোগ করা।চারপাশে নিশ্চুপ হয়ে আছে প্রকৃতি।প্রকৃতি যেন আজ মনের সাথে একাকার হয়ে আছে।নির্মল আনন্দের জন্য এরকম একটি লঞ্চ ভ্রমনই যথেষ্ট।এক সময় ঘুমের রাজ্য হারিয়ে লঞ্চের ডেকেই নাক ডাকা।
হঠাৎ বাঁশির শব্দে ঘুম ভাঙল।ভোর ৫ টা।ধান-নদী-খাল এই তিনে মিলে বরিশাল।হ্যা, পৌঁছে গেছি বাংলার ভেনিস কীর্তণখোলার তীরে। বরিশাল।
‘নদী আমাদের “মা” আসুন নদীকে বাঁচাই।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন