বদলে যাচ্ছে বিশ্বের জলবায়ু
করোনাভাইরাসের আক্রমণে থমকে আছে জনজীবন, জীবিকার সংকট হয়ে উঠছে তীব্র, অর্থনীতির চাকা থমকে গেছে। তবু অভাবনীয় উনড়বতি হচ্ছে নানা ক্ষেত্রে। বিশ্বের জলবায়ুতে উন্নতি হচ্ছে। প্রাণীদের জীবনযাপনে নতুন প্রাণ আসছে।
জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমেছে। এমন নানা পরিবর্তন নিয়ে দৈনিক দেশ ররূপান্লিতরে লিখেছেন শফিকুল ইসলাম। (২২ মে ২০২০)
কোথাও কেউ নেই
করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব ঠেকাতে সারা বিশ্বে এখন লকডাউন। তাতে মানুষের কাজ থেমে গেলেও প্রকৃতিতে প্রাণ ফিরেছে। কর্মমুখর বিরাট বড় শহরগুলোতেই শুধু নয়, সুনসান নীরবতা নেমে এসেছে প্রায় সব দেশের প্রত্যন্ত ছোট শহরেও। ফলে প্রকৃ তি দূষণের হাত থেকে বেঁচে ধীরে ধীরে আরও সজীব হচ্ছে। তাতে দুনিয়ার সবচেয়ে উনড়বত দেশ যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার অঙ্গরাজ্যের জমকালো সৈকতে চলে এসেছে সারি সারি ডলফিন। যে দক্ষিণ আফ্রিকার সংরক্ষিত বন ক্রুগার ন্যাশনাল পার্ক’ পর্যটকের ভিড়ে ব্যস্ত থাকত, সেখানে এখন কেউ নেই। গাড়ি না থাকায় পর্যটকের ব্যস্ত রাজপথে ভয় কাটিয়ে চলে আসছে সিংহের দল। ভিতু হরিণের পাল অবাধে সাহসে ভর দিয়ে বন থেকে বেরিয়ে পড়েছে জাপান, কানাডার পথে পথে।
জাপানে তো তারা সবার মতো হাঁটছে আন্ডারপাসেও। আমাদের বাংলাদেশেও অন্যথা হয়নি। কক্সবাজারের সমুদ্র সৈকত এখন খালি। সেখানে দূষণ নেই। পর্যটকের ভীড় নেই। ফলে ডলফিনের অবাধ বিচরণ হচ্ছে; সাগরের পাড়ে ফুটেছে ‘সাগর লতা’ ফুল। পটুয়াখালীর কুয়াকাটা ও গঙ্গামতি সাগর সৈকতে দীর্ঘদিন ‘বেদখল’ বেলাভূমি মানুষের হাত থেকে আবার নিজেদের কব্জায় এনেছে লাল কাঁকড়ার পাল। চলছে তাদের অনিন্দ্য মিছিল। ভিতু নেকড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সান ফ্রান্সেসকো শহরের গোল্ডেন গেট ব্রিজের ওপর উঠে গিয়েছে। তাদের রাষ্ট্রপতির দপ্তর হোয়াইট হাউজ থেকে মোটে কয়েক মাইল দূরে হরিণ চরছে। ইতালির বার্সেলোনাতেই শুধু নয়, বের্গামো শহরেও বনের শূকরের পাল সাহসী হয়ে উঠেছে। ব্রিটেনের ওয়েলসে ময়ূরের পাল বন ছেড়ে এসেছে লোকালয়ে। এত এত পরিবর্তনে অবাক হয়ে গিয়েছেন পরিবেশবাদীরাই। বিশ্বের পরিবেশ বাঁচাতে যারা নিয়মিত আন্দোলন করেন দেশে দেশে; সেই তারাই বলছেনÑ মানুষ ও প্রাণীর অসাম্যের এই বিশ্বে ছবিগুলো পুরোপুরি আলাদা।
কমেছে কার্বনের মাত্রা
মানুষের হাত থেকে বেঁচে প্রকৃতি খুব সহজে শ্বাস নিচ্ছে। পথে-ঘাটে এখন গাড়ি কমে গেছে; কলকারখানা বন্ধ। চীন, ইতালি, ব্রিটেন, জার্মানি কার্বন-ডাই অক্সাইড ও নাইট্রোজেন পার-অক্সাইড গ্যাস নিঃসরণ করতে পারছে না। এই গ্যাসগুলো নিঃসরণের মাত্রা ৪০ শতাংশ কমে গিয়ে বিশ্বের বাতাসের মানের অসাধারণ উনড়বতি হয়েছে। কার্বন-ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ কমেছে সারা দুনিয়ায়। গেল বছরের মার্চ ও এই বছরের মার্চের তুলনামূলক হিসেবে, করোনাভাইরাসে বিশ্বের বিমান চলাচল অর্ধেক হয়েছে। মার্চে ব্রিটেনের রাস্তাঘাটে গাড়ি চলাচল কমেছে ৭০ ভাগের কম। ৫০ বছর ধরে কমতে থাকা পরিবেশের নানা সূচক এই কদিনে অনেক বেড়েছে। চীনকে বিশ্বের বৃহত্তম কার্বনের আধার বলা হয়, তারা ব্যাপক কার্বন-ডাই অক্সাইড বাতাসে ছড়ায়; তাদের এ বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত কার্বনের নির্গমন ১৮ ভাগ বেড়েছিল, এখন কমে গিয়েছে। যাদের উনড়বততর বিশ্ব বলা হয়, সেই ইউরোপ মহাদেশের দেশগুলো একত্রে ৩৯০ মিলিয়ন টন কার্বন কমাচ্ছে বলে বিজ্ঞানীরা জানিয়েছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রায় ৪০ ভাগ কার্বন কমিয়েছে। যাত্রীবাহী গাড়িগুলো থেকে তাদের সবচেয়ে বেশি কার্বন উৎপাদন হয়। বিজ্ঞানীরা আশা করছেন পরিবেশবাদীরাও বলছেন- লকডাউন শেষে ২০০৮-০৯ অর্থবছরে বিশ্বের অর্থনীতি যেভাবে ধসে পড়ে কার্বন-ডাই অক্সাইডে নির্গমন কমিয়ে দিয়েছিল, তেমন চেহারা পেতে পারে পৃথিবী। পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা খুব আশাবাদী, জীবাশ্ম জ্বালানি ছাড়া বিশ্ব কীভাবে চলতে পারে, চেহারা কেমন হতে পারে এ তার অনন্য ঝলক। তারা জানিয়েছেন, সারা দুনিয়াতে এই কদিনে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার তিন ভাগের দুই ভাগ কমেছে। আন্তর্জাতিক রুটে বিমান চলাচল দুনিয়ায় জ্বালানি নির্গমনের অন্যতম দায়ী। এ খাতে ভ্রমণের নিষেধাজ্ঞা কার্যকর বলে মহামারী রোগটিতে আকাশের বায়ু একেবারে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে, নিতান্তই কম বায়ুদূষণ হচ্ছে। এক গবেষণার ফলাফলে জানা গিয়েছে, পৃথিবীতে উষ্ণতার মাত্রা বাড়ার পেছনে বিমান চলাচল পাঁচ ভাগ দায়ী। আগের বছরগুলোর চেয়ে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে মার্চ তিনটি মাসে ৬ কোটি ৭০ লাখ যাত্রী কম পরিবহন করা হয়েছে। জীবাশ্ম জ্বালানি শিল্পকে প্রবলভাবে আক্রান্ত করেছে লকডাউন। দেশে দেশে গাড়ি চলাচল কমেছে। সংশ্লিষ্ট খাতগুলোয় স্থবিরতা এসেছে। তেলের দাম গেল বছরের এ সময়ের চেয়ে এখন তিন ভাগের দুই ভাগ কমেছে। মার্চে গাড়ি বিক্রি ৪৪ ভাগ কমেছে।
সংকটের আড়ালে অনেক কিছু
আবার অর্থনীতিতে আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের কার্যালয় হোয়াইট হাউজ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন প্রয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। তাদের তিনটি অঙ্গরাজ্যে জীবাশ্ম জ্বালানির বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারীদের অপরাধী হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। কানাডা ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জ্বালানি তেলের পাইপলাইন কেএক্সএলের নির্মাণ শুরু হয়েছে। মার্কিন তেল কোম্পানিগুলোর বেইল আউট’র জন্য জোর চেষ্টা চালাচ্ছে ট্রাম্প প্রশাসনে। মার্কিন সরকার তাদের অর্থনৈতিক উদ্দীপনা নামের বিরাট বিলে বিমান সংস্থাগুলোর জন্য ৫০ বিলিয়ন বেইল আউট অন্তর্ভুক্ত করেছে। তাদের ঠেকানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলোর কর্মীরা। তারা ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ব্রিটেনকে পরিবেশের ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ, উদ্যোগ না নিতে অনুরোধ করেছে। তারা বলেছে, সব দেশের সরকার যদি আবার আগের ব্যবসায়িক অবস্থায় ফিরে আসতে সব ধরনের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কোনো বিবেচনা না করেই শুরু করেন, তাহলে পরিবেশের এমন উনড়বতি কোনো কাজে আসবে না, আলাদা উনড়বয়ন ঘটবে না। চীন উহানে লকডাউন শিথিল করে আবার জ্বালানি তেলের ব্যবহারসহ নানাভাবে পরিবেশ দূষণ আগের মতো বাড়ানো শুরু করেছে। কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিনড়ব দেশে এই জাতীয় সংকটে, যা পুরো অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে থমকেছে; শক্তিশালী ও অভিজাত শ্রেণি পরিবেশ ও শ্রম অধিকারের মৌলিক বিষয়গুলোতে অপ্রচলিত নানা পদক্ষেপ নিয়ে চলেছেন, জাতীয় সংকটকে ব্যবহার করছেন তাই নিয়ে লিখছেন বিখ্যাত কানাডিয়ান লেখক, সমাজকর্মী ও পরিচালক নওমি ক্লেইন।
আশা জাগছে
এখন পরিবেশের ভালো হচ্ছে। মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার হিসেবে, তাদের দেশের ঘনবসতি শহরাঞ্চলের বায়ুদূষণ ৩০ ভাগ কমেছে। বিশ্বে পরিবহন জীবাশ্ম জ্বালানি ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে নাইট্রোজেন পার-অক্সাইড গ্যাসের নির্গমন ২০০৫ সাল থেকে আজতক সবচেয়ে কম হয়েছে এই মার্চেই। বিশ্বের জলবায়ু ঘুরে দাঁড়াবে এই ভাবনাটির জন্য এ অত্যন্ত সুসংবাদ। কার্বন- ডাই অক্সাইড গ্যাসের নিঃসরণ এই গ্রহের উষ্ণতাই কেবল বাড়ায় না, পুরো প্রাকৃতিক আবহাওয়া ব্যবস্থাকে ভেঙে দেয়। এভাবে নিঃসরণ যে কমতে পারে, তা কারও ধারণাতেই ছিল না। ফলে চমকে গিয়েছেন সবাই। গ্লোবাল কার্বন প্রজেক্টের চেয়ারম্যান রব জ্যাকসনও অবাক হয়ে বলেছেন, ‘বিশ্বজুড়ে কার্বন-ডাই অক্সাইডের এমন করে নিঃসরণ কমানো নজিরবিহীন। তাতে বিশ্বের বেশির ভাগ এলাকার বায়ুদূষণ কমেছে। ’ বলতে বাধ্য হয়েছেন, ‘ভাইরাসটি সারা বিশ্বের সব মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, চাইলেই আমরা সবাই মিলে বায়ু অত্যন্ত দ্রুত পরিষ্কার করে ফেলতে পারি। ’ তিনি সতর্ক করেছেন, ‘মানুষের খরচ খুব বেশি বলে পরিবেশগত এ পরিবর্তনগুলো সাময়িক প্রমাণ হতে পারে। আমাদের শক্তি ব্যবহারের অবকাঠামোগত পরিবর্তন প্রয়োজন। ’ ব্যথাও পেয়েছেন, ‘কার্বন-ডাই অক্সাইডের নিঃসরণ কমানো আমরা উদযাপন করতে পারছি না। কারণ কয়েক লাখ লোকের চাকরি হারানোরও ফলাফল এটি। ’ তবে শিল্প-কারখানাগুলো বন্ধ থাকায়, বিমানের ফ্লাইটসহ গণপরিবহন ও ব্যক্তিগত গাড়িগুলো রাজপথে চলা থেমে যাওয়ায় গ্রিন হাউজ গ্যাসের নির্গমন বিপুলভাবে কমেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, এই গ্যাসের প্রভাবে প্রতি বছর প্রায় ৩০ লাখ মানুষ মারা যান। ৮০ ভাগ শহরে বাস করেন। কম আয়ের দেশগুলোর ৯৮ ভাগ শহরই বায়ুর মান পূরণ করতে পারে না বলে মানুষ মারা যায় ব্যাপক। লকডাউনে বিশ্বের পরিবেশের উনড়বতিতে সারা বিশ্বের সব মানুষের গড়ে হাঁপানি, হার্ট-অ্যাটাক ও ফুসফুসের রোগ কমেছে। স্বাস্থ্য খাতে এ বিরাট পরিবর্তন। পরিবেশ বিজ্ঞানী, সচেতনরা আশা করছেন, দেশে দেশে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, কল-কারখানাগুলোর চাকা থেমে কার্বন নির্গমন আরও বিরাট মাত্রায় কমবে। তারা এ ক্ষেত্রে বিপদ হিসেবে আগাম সতর্ক করছেন, ২০০৮-০৯ অর্থবছরের অভিজ্ঞতাকে। তখন অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে থাকে তেল, কয়লা এবং অন্যান্য জীবাশ্ম জ্বালানির মাধ্যমে। ফলে বিকল্প প্রয়োজন। ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সির হিসেবে, করোনাভাইরাসের আμমণের শুরুর দিকে এ বছরের জানুয়ারির শেষ ও ফেব্রুয়ারির শুরুতে এশিয়া ও ইউরোপের শহর ও শিল্প এলাকাগুলোতে ২০১৯ সালে তখনকার চেয়ে বাতাসে নাইট্রোজেন পার-অক্সাইডের মাত্রা ৪০ ভাগ কম ছিল। এক ব্রিটেনে লকডাউন ঘোষণার দুই সপ্তাহ পর ২০১২ সালের এ সময়ের চেয়ে ৬০ ভাগ দূষণ কম হয়েছে। নাসার তথ্য মতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্ক ও উত্তর-পূর্ব আমেরিকা মহাদেশের প্রধান শহরগুলোতে ২০১৫ থেকে ২০১৯ সালের সে সময়ের চেয়ে এ বছরের মার্চে ৩০ ভাগ বায়ুদূষণ কমেছে। বাতাসে কার্বন ছড়ানো বন্ধ হওয়ায় ভীষণ অবাক হয়ে গিয়েছেন বিজ্ঞানীরা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মেরিল্যান্ডের নাসার নাসা গডার্ড স্পেস ফ্লাইট সেন্টারের বিজ্ঞানী ও গবেষক লেই ফিউ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দি গার্ডিয়ানকে বলেছেন, ‘কোনো একটি নির্দিষ্ট ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিরাট বিস্তৃত শহরগুলোতে একত্রে এ ধরনের নাটকীয় ঘটনা প্রম দেখলাম। ’ তিনি জানিয়েছেন, চীনের উহানে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের শুরু ২৩ জানুয়ারি। রোগটি ছড়ানো শুরু করলে উহানের পাশাপাশি অন্য শহরগুলোকেও লকডাউন করে দেয় চীন সরকার। এরপর অন্যান্য দেশেও তাই করতে হয়। সারা বিশ্বেই লকডাউন পরিবেশের উনড়বতি করেছে ব্যাপকভাবে। স্পেনের মাদ্রিদে জেনারেল ট্রাফিক বিভাগ মার্চে ১৪ ভাগ ড্রপ অব নিবন্ধন করেছেন। অথচ গেল বছর রাজধানী শহরটির পৌর কর্তাদের ইউরোপীয় কমিশন জনগণের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় পরিকল্পিত বায়ুর জন্য ইইউর বেঁধে দেওয়া সীমা পূরণ করতে না পারায় আদালতের মুখোমুখি করেছিল। একটি ভয়াবহ তথ্যই চমকে দেবে, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মাত্র মাসখানেক আগে বায়ুতে দূষণ ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় থাইল্যান্ডের রাজধানী ব্যাংককের বিদ্যালয়গুলো শিশুদের জীবন বাঁচাতে বন্ধ করে দিতে হয়েছে। ২২ মার্চ থেকে ভারতের রাজধানী দিল্লিতে কারফিউ চালুর পর সেখানে তো বটেই পুরো ভারতেরই বায়ুর মান অনেক বেড়েছে। আরও আশার আলো ছড়াচ্ছে পরিস্থিতি। চীন বিশ্বের বৃহত্তম কার্বন নিঃসরণ করা দেশ। কার্বন ব্রিফ নামের যুক্তরাষ্ট্রের নির্মল আবহাওয়ার জন্য কাজ করা প্রতিষ্ঠানের এক গবেষণায় জানা গিয়েছে, দেশটিতে লকডাউনের ফলে কার্বন-ডাই অক্সাইডের নির্গমন প্রায় ২৫ ভাগ কমেছে কমেছে। বিজ্ঞানীরা বলেছেন, বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের চাহিদা কমানো গেলে কার্বনের চাহিদা অনেক কমানো সম্ভব হবে। ইন্টারন্যাশনাল এনার্জি এজেন্সির মতে, সেই কাজ এ বছর সর্বত্র বিশ্বব্যাপী তেলের চাহিদা কমার মাধ্যমে শুরু হবে। এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক ফায়তি বিরল বলেছেন, করোনাভাইরাসের প্রভাবে ভ্রমণসহ বড় ধরনের অর্থনৈতিক ক্রিয়া কাণ্ড কমবে। মহামারী রোগটি শক্তির অন্য উৎসের বাজারগুলোতেও বিস্তৃত প্রভাব ফেলবে। দুনিয়ার সবচেয়ে বড় ভোক্তা চীনসহ পুরো পৃথিবীর পরিবহন জ্বালানিতে ঘাটতি শুরু হয়ে গিয়েছে। করোনাভাইরাস তেলের বাজারগুলোতে মারাত্মক আঘাত হেনেছে। করোনাভাইরাসের প্রতিক্রিয়া অন্যান্য অংশেও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। ফলে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে অর্থনীতিবিদদের, রাষ্ট্র পরিচালকদের।
স্বচ্ছ জলে পাখপাখালির মেলা
লকডাউনে নদীদূষণ নেই বলে ভারত ও বাংলাদেশের প্রধান নদী গঙ্গা ও পদ্মা বেঁচেছে। ইতালির ভেনিস শহরের যে খালগুলো সারা দুনিয়ার পর্যটকদের দেখার স্থান; সেগুলোতে গেল ৬০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে পরিষ্কার ও মানসম্পনড়ব পানি এসেছে। নোংরা, ধূসর জল এখন আয়নার মতো স্বচ্ছ। তাতে পরিযায়ী, আশপাশের, বনের সাদা হাঁস, সাগরের পাখি এসে বেড়াচ্ছে। খালে নানা প্রজাতির মাছ বংশবিস্তার করতে পারছে। নৌকাগুলো (ওয়াটার বোট নামেই চেনেন সবাই) এখন আর নেই। থেমে আছে কিনারে। তারা আবার জলের দখল পেয়েছে। হঠাৎ করে একটি ভাইরাসের আক্রমণে সব সময়ের নৌকাগুলো থেমে যাওয়ায় খোদ ভেনিসের অধিবাসীরাই হতভম্ব। কীভাবে এত পরিষ্কার হলো তাদের পানি? সেটি এখন তাদের আনন্দের বিষয়। একজন অধিবাসী বলেছেন, ‘আমাদের খালগুলোর পানি আয়নার মতো, শুধু তাকাতে হয়। তাহলেই নিজেকে দেখতে পারবেন। কোনো জলযান, নৌকা নেই। সব থেমে গিয়েছে। ’ ভারতের বেনারসের ঘাটগুলো বন্ধ। সেখানে নদীর ধাপেই মাছ চরে বেড়াচ্ছে। শিল্প- কারখানার বর্জ্য আর নদীতে ফেলা হচ্ছে না বলে ভারতের দ্বিতীয় সবচেয়ে বড় পানির প্রবাহ যমুনা নদীর পানিও চকচকে।
বদলেছে জীবন
করোনাভাইরাসের মধ্যে পরিবর্তন শুরু হয়ে হয়েছে দেশে দেশে খাবার গ্রহণের পদ্ধতিতে। বিখ্যাত কফি প্রতিষ্ঠান স্টারবাক গ্রাহকদের একবার মাত্র ব্যবহার করা যাবে এমন পরিবেশবান্ধব কাপ দেওয়া শুরু করেছে। তাতে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকানো যাবে। প্যাকেটজাত খাবার খাওয়ায় সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ইউরোপীয় ফুড সেফটি অথরিটি মহাদেশটির মানুষদের অভয় দিয়েছেন, সেগুলো থেকে এখনো ভাইরাসটি ছড়ানোর কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। চীন তাদের হাসপাতালগুলো থেকে ব্যবহার করা মাস্ক, টিস্যুসহ সব ধরনের ব্যবহৃত চিকিৎসা বর্জ্যে চিরতরে সরিয়ে ফেলছে। প্রম আক্রান্ত শহর উহানে এই মেডিকেল বর্জ্য দিনে প্রায় ৮০০ টন। সংক্রমণের ভয়ে এগুলো পুনর্ব্যবহারের অতি আধুনিক প্রযুক্তি থাকার পরও রিসাইক্লিং না করে পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। চিকিৎসা ক্ষেত্রে এই অসাধারণ পরিবর্তনের পাশাপাশি, জনস্বাস্থ্যের উনড়বতির লক্ষ্য পূরণের দিকে দেশগুলো একে একে হাঁটতে শুরু করেছে। জলবায়ুর পরিবর্তনেও মৌলিক উনড়বতি হচ্ছে করোনাভাইরাস ও লকডাউনের ফলে। কয়েকজন বিশেষজ্ঞ নিশ্চিত করেছেন, যে দেশগুলো ২০১৫ সালের প্যারিসের বিখ্যাত জলবায়ু চুক্তির লক্ষ্যগুলো পূরণ করতে পারেনি; তারা এখন মহামারীর মাধ্যমে সেগুলো পূরণ করতে পারছে। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ায়, কখনো উনড়বতির বাইরে চিন্তা না করায় উনড়বত বিশ্বের দেশগুলোর মধ্যে লকডাউনের ফলাফলে বিভ্রান্তি ও বিভেদ রয়েছে। আবার বিশ্বের বন্যপ্রাণী ও পরিবেশের এখন প্রধান ভা-ার অনুনড়বত তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষিণ গোলার্ধ, যেটি আমাদের সেখানে বিপনড়ব বন্যপ্রাণী ও তাদের আবাস ও বিশ্বের অক্সিজেনের চাহিদা পূরণের ক্ষেত্রগুলোর মালিকদের সেগুলো বাঁচাতে টাকা ও লোকবলের বিরাট সংকট আছে। বিশ্বের ফুসফুস আমাজনের বৃষ্টিময় বনমালা সুরক্ষা কার্যμম চলছে। সেখানেও কভিড-১৯ রোগ আক্রমণ করেছে ও রোগী মারা গিয়েছে। কেনিয়ার মাসাই মারা ন্যাশনাল রিজার্ভ, পাশের তানজানিয়ার সেরেংগেটি ন্যাশনাল পার্কের মতো সংরক্ষিত বনাঞ্চলে পর্যটকদের কাছ থেকে কম রাজস্ব আদায় করা হয়; যাতে তারা আসেন ও সেগুলো বেঁচে থাকতে পারে। তবে সেসব জায়গাতে স্থানীয়দের আয় কম, তারা প্রাপ্য বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা বনের জন্য মায়া না করে জীবন বাঁচাতে বনের বিনাশও করছেন। ফনা অ্যান্ড ফ্লোরা ইন্টারন্যাশনালের অন্যতম বিশেষজ্ঞ ম্যাট ওয়ালপোল আক্ষেপ করেছেন, ‘এমন কাজের অনেক ঝুঁকি। এ ধরনের অল্প মেয়াদের ও স্বল্পক্ষণের কার্যμম খারাপ অবস্থায় চলে আসা অর্থনীতির জন্য উপকারী নয়, বিপজ্জনক। ’ তবে তারাও লকডাউনের পর নতুন বিশ্বের আশায় আছেন। কারণ পর্যটন বন্ধ বলে প্রাণী ও পরিবেশ নিজেদের মতো করে, চিরপরিচিত ভুবনে ভালোভাবে বাঁচতে পারছে। এভাবেই সবার মধ্যেই আশা, মহামারী শেষে স্বচ্ছ ও নতুন এক পৃথিবীর শুরু হবে। তবে স্বাস্থ্যকর, পরিচ্ছনড়ব পৃথিবীর জন্য করোনাভাইরাস বা তার মতো কোনো রোগের প্রাদুর্ভাব বা প্রভাব নয়, দীর্ঘকালের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, সবার চেষ্টার ওপরই নির্ভর করবে বর্তমান ও আগামী।
দেশ রূপান্তর লিংকঃ https://www.deshrupantor.com/specially/2020/05/21/219639
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন