অপার সৌন্দর্যে দক্ষিণবঙ্গের বাতিঘর।



শফিকুল ইসলাম ।
বরিশালের বুক চিড়ে নেমে এসেছে এক জাদু কাটা নদী 'কীর্তনখোলা'এ নদীতে প্রতিদিন চলে পালতোলা নৌকা, শতশত বালি কয়লার জাহাজ আর শ্রমিকের জীবন যুদ্ধ । নদীর তীর ঘেঁষে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি গড়ে উঠেছে। আকাশের সমস্ত নীল যেন গিয়ে ঠেকেছে কীর্তনখোলার তীরে। এ নদীর উপর নির্মিত শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত সেতুর উপর দাঁড়ালে নয়নাভিরাম সৌন্দর্য  হাতছানি দিয়ে ডাকে। চারদিকে ঘন সবুজের সমারোহ। এ যেন প্রকৃতি প্রেমী শিল্পির রংতুলিতে আঁকা ছবি। চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নয়নাভিরাম দৃশ্যপট। 

পাখির চোখে ববি 

সেতু থেকে নেমেই বাম পাশে বিশ্ববিদ্যালয় । হাইওয়ে সংলঘ্ন হওয়ায় পথযাত্রীরা জানাল দিয়ে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে নান্দনিক স্থাপত্যশৌলির দিকে। বলছিলাম দক্ষিণবঙ্গের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা। 

নীল আকাশ ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন নিয়ে ঘুমুতে যাওয়া ছোট ছোট গাছগুলো যেন ঘোষণা করে বিশ্ববিদ্যালয়ের মহিমা। এখানে ক্ষয়ে যাওয়া প্রতিটি সময়ে স্বপ্নেরা ডানা মেলে । দুঃস্বপ্ন গুলো হারিয়ে যায় ঔ দূর আকাশে। কীর্তনখোলার তীরে গোধূলির আকাশ কখনো বিষাদ হয় না। অগনিত জুটির প্রেমের সাক্ষী নদীর ওপাশে ঢলে পড়া রক্তিম সূর্য। পিঙ্গল বর্নের আকাশটা ধুসর হয়ে উঠলে, সন্ধ্যার আধো অন্ধকার চারপাশে ছড়িয়ে পড়তেই সুন্দরকরে কাটা নখের মত এক ফাঁলি চাঁদ সন্ধ্যা তারার পাশে উঁকি মারে। সন্ধ্যায় শহীদ মিনার, মুক্তমঞ্চে জমে গানের আড্ডা। মুক্তমঞ্চের নির্মল বাতাস আর গানের সুরতান মুহূর্তেই দুর করে দেয় প্রাণের সকল বিষন্নতা। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় সকালে একরুপ বিকালে আর এক রুপ। ভোরবেলা বঙ্গবন্ধু হলের রুমগুলোর সমস্ত নিরবতা ফালি ফালি করে চিড়ে দেয় শালিকের গান। ক্যাম্পাসে ভোরের আকাশটা অন্য রকম । সূর্য রশ্মীর খেলা ছায়া ধরা দেয় প্রতিটি বালুকনায়।



শুরু থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়টি দক্ষ, মুক্তিবুদ্ধি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় মানব সম্পদ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বর্তমান শতাব্দীর চ্যালেঞ্চ মোকাবেলায় নানামুখি সাফল্য ও কৃতিত্বের সাক্ষর রাখতে সক্ষম হয়েছে। পরিনত হয়েছে হাজারো শিক্ষার্থীর আস্থায়। বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ও প্রত্যাশা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। একঝাঁক তরুণ শিক্ষক মন্ডলীর একান্ত প্রচেষ্টায় দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে শিক্ষা কার্যক্রমবিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের হস্তক্ষেপের কারণে এখন পর্যন্ত এখানে রাজনৈতিক হানাহানি মুক্ত। ইতিমধ্যেই বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব কালচার গড়ে উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়কের‍্যাগিংমুক্ত, মাদকমুক্ত ও  ধূমপানমুক্ত পরিবেশবান্ধব সবুজ ক্যাম্পাসহিসেবে ঘোষিত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রথম ক্যাম্পাস যা র‍্যাগিং ও ধূমপান মুক্ত ক্যাম্পাস  হিসেবে স্বীকৃত ধূমপায়ী কোনো শিক্ষার্থীকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি  না করার জন্য পদক্ষেপ নিয়েছিলেন সাবেক উপাচার্যসেই সঙ্গে ভর্তি পরীক্ষায় অধূমপায়ীদের অগ্রাধিকার দেওয়ার কথাও বলা হয়েছে। 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণরা জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে  অল্প সময়ে নিয়ে এসেছে একাধিক সাফল্য। তারা তাদের অর্জনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় ও দেশের মুখ করেছে উজ্জ্বল। বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যদল, যারা ইতিমধ্যে খ্যাতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে জাতীয় পর্যায়ে। ‘দ্বীন দ্যা ডে’ সিনেমার জন্য সারা দেশ থেকে মুনসুন ফিল্মস এর ট্যালেন্ট হান্ট রিয়ালিটি শো’ তে এণ্টি হিরো ক্যাটাগরিতে  চ্যাম্পিয়ন হয় বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় নাট্যদলের  রিয়াজুল ইসলাম রিয়াজ,  রয়েছে ক্রীড়া অঙ্গনেও অসামান্য সাফল্য।

সাংস্কৃতিক চর্চায় রয়েছে শিক্ষার্থীদের প্রতিভার বিকাশক্যাম্পাস সূচনার পর থেকে ঘরে-বাইরে খেলাধুলায় রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের স্বতঃস্ফূৎ অংশগ্রহণ। ক্রীড়া প্রতিযোগিতা, সেমিনার-সিম্পোজিয়াম, বিভিন্ন অলিম্পিয়াড, বইমেলা, কবিতা উৎসব, পিঠা উৎসব, ফুসকা ফেস্ট, সহ নানা আয়োজনে ক্যাম্পাস হয়ে ওঠে মুখরিত। ডিবেটিং সোসাইটি নাট্যদল  মুক্ত বুদ্ধি চর্চা ও সাংস্কৃতি কর্মকান্ডে গুরুত্বপূর্ন অবদান রেখে আসছে  তাছাড়াও বিভিন্ন সৃজনশীল কর্মকাণ্ড, পেশাভিত্তিক উন্নয়নের জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠানে রয়েছে বিভিন্ন বিভাগের শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ ও অর্জন। ইয়্যুথ ফেস্ট, বাংলাদেশ ইনোভেশন ফোরাম, নাসা অ্যাপস এর বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় রয়েছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অসামান্য অর্জন সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত স্পাইক এশিয়া ফেস্টিভ্যাল অব ক্রিয়েটিভিটিতে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষার্থী গোলাম রব্বানী। 


সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগের (সিএসই) শিক্ষার্থীদের তৈরি কৃষি কাজে ব্যবহার উপযোগী ড্রোন উদ্ভাবনের পর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রথমবারের মতো সফলভাবে  আকাশে উড়ানো হয়েছে। ড্রোনটি দিয়ে জমির ছবি ধারণ করা,  নির্দিষ্ট দূরত্বে বা প্রত্যন্ত এলাকায় অনাবাদি বা কম ফলনশীল জমির অবস্থা নিরূপণ এবং পরবর্তী সময়ে এসব ছবি অ্যানালিসিস করে বের করা যাবে এসব জমি কেন অনাবাদি, কী পরিমাণ চাষাবাদ হচ্ছে, সমস্যাটা কোথায়, কিভাবে আবাদযোগ্য করা যায়। ফসলে কোনো ধরনের পোকা বা জীবাণু আক্রমণ করেছে কি না তা-ও শনাক্ত করা যাবে। ড্রোনের মাধ্যমে বিশাল কোনো জমিতে নিখুঁতভাবে সার বা কীটনাশক দেওয়ার কাজটিও করা যাবে। কৃষিক্ষেত্রে এ রকম নানা সমস্যা চিহ্নিত করে গবেষণার মাধ্যমে সমাধানের জন্য কাজ করা যাবে। 

বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক  থেকে শুরু করে ক্লাসরুম, গ্রন্থাগারে বই, আবাসিক হল, বাসসহ  নানান সংকট রয়েছে। নানা সংকট সত্ত্বেও ছাত্রদের মেধা মননকে কাজে লাগিয়ে সুপ্ত প্রতিভার উন্মেষ ঘটানোর জন্য শিক্ষা ও সংস্কৃতির সম্বন্বয়ে গৃহীত হয়েছে বহুমুখী পদক্ষেপ। এ দর্পনে ধরা পড়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দেশ, সমাজ, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বাস্তব চিত্র। সত্যের পথে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ানো অপসংস্কৃতির সকল বেড়াজাল ছিন্ন করে, বাধার বিন্দাচল উপেক্ষা করে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন নিয়ে, বিশ্বজনীন আলো ছড়িয়ে দিতে এক ঝাঁক তরুণ শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের চলছে অবিরাম প্রচেষ্টা।
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৩ সালে তৎকালীণ বেলস পার্কের (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু উদ্যান) জনসভায় বরিশালে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। ২০১১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। অগ্রযাত্রার ৯ম  বর্ষে পদার্পণ করেছ দক্ষিণবঙ্গের বাতিঘর বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।

রাতের ববি। ছবিঃ তানভীর আহমেদ।
ছবিঃ তানভীর আহমেদ

স্বপ্ন ফেরি করা লাল বাস




শেখ হাসিনা হল
রাতের সেতু
ছবিঃ তানভীর আহমেদ






মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফিচার কী? একটি সুন্দর ফিচার কিভাবে লিখবেন? উপাদান, বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ।

চার কৌশলে সর্বোচ্চ সিজিপিএ, পেলেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক

কবে জুতা মুক্ত হবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার?