শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদীর সন্ত্রাস বাড়ছে?
শফিকুল ইসলাম।
নিউজিল্যান্ডকে বলা হয় শান্তির স্বর্গোদ্যান। গত সপ্তাহে নিউজিল্যান্ডের
ক্রাস্টচার্চ শহরের দুটি মসজিদে হামলায় ৫ জন বাংলাদেশিসহ ৫০ জন নিহত হয়েছে। ‘ব্রেন্টন ট্যারেন্ট’ নামক একজন শ্বেতাঙ্গ উগ্র ও ডানপন্থী অস্ট্রেলিয় নাগরিক সহিংস
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডটি ঘটান। ব্রেন্টন
ট্যারেন্ট আল নূর মসজিদে হামলার সময় তার হেলমেটে বসানো ছিল ক্যামেরা। যা দিয়ে অনলাইনে সরাসরি সম্প্রচার করা হচ্ছিল এই হামলা। এই
হামলার পূর্বাভাস হিসেবে তিনি "ব্যাপক প্রতিস্থাপন"
("The Great Replacement") শিরোনামে একটি ৭৩ পৃষ্ঠার ইশতেহার
পোস্ট করেন। "ব্যাপক প্রতিস্থাপন" হচ্ছে শ্বেতাঙ্গ গণহত্যা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব ও এর ফরাসী প্রকরণের একটি সূত্র। হামলাকারী একজন ইসলাম-বিদ্বেষী ব্যক্তি। এই ইস্তাহারে বিভিন্ন মুসলিম বিরোধী
এবং অভিবাসন বিরোধী অনুভূতির প্রকাশ পাওয়া যায়। অভিবাসীদের বিরুদ্ধে কটূক্তি,
শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ববাদী অলঙ্করণ, এবং শ্বেতাঙ্গ
জাতির রক্ষার জন্য রাষ্ট্রে আক্রমণকারী মুসলিমদের হত্যা করার আহ্বানও ছিল। যা থেকে স্পষ্ট হয় যে তিনি মুসলমানদের ঘৃণা করেন। তিনি ২০১১ সালে অসলোতে ৭৭ জনকে হত্যাকরা অ্যান্ডারর্স ব্রেইভিকসহ অন্য শেতাঙ্গ হামলাকারীদের থেকে অনুপ্রানিত। এই হামলার মধ্য দিয়ে শেতাঙ্গদের বিজয় হবে বলে দাবি করেন তিনি। হামলাকারী
ওই ইশতেহারে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশংসা করেন।
২০১৫ সালে ফিরে যাওয়া যাক। ১৭ জুন সন্ধ্যায় যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ
ক্যারোলিনার কৃষ্ণাঙ্গদের একটি গির্জায় চরম বর্ণবাদী তরুণ ডিলান রুফ ৯ জনকে হত্যা করে। ডিলান রুফ কুখ্যাত দাস প্রথা সমর্থক, মার্কিন সেনাবাহিনীর পতাকা ও পিস্তল হাতে নিয়ে
বর্ণবিদ্বেষমূলক ইশতেহার ঘোষণা করেছিল। ঊনবিংশ শতাব্দীতে গৃহযুদ্ধকালে কনফেডারেশন সমর্থক
বাহিনী এমন পতাকা ব্যাবহার করত। ওই গৃহযুদ্ধ অবসানের পর দাস প্রথা সমর্থকেরা ১৮৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিঙ্কনকে হত্যা করে। কৃষ্ণাঙ্গদের দাসলতুল্য মনে করে নতুন যুক্তরাষ্ট্র
গড়তে চেয়েছিল ডিলান রুফ। ব্রেন্টন
ট্যারেন্ট ইশতেহারে ডিলান রুফ,এন্ডারসন বেহরিং ব্রেইভিক এর প্রতি সমর্থন দিয়েছে। ইউরোপীয় ও আমেরিকান সমাজগুলি শেতাঙ্গ আধিপত্যবাদের
হুমকিকে যেভাবে গূরত্বসহকারে নেওয়া উচিত সেভাবে নিচ্ছে না। প্রধানমন্ত্রী জাসিন্ডা হামলার এ ঘটনাকে ‘নজিরবিহীন’ এবং
‘সন্ত্রাসী হামলা’ বলে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু পশ্চিমা মিডিয়াগুলোর ব্রেন্টন ট্যারেন্টকে সন্ত্রাসী
বলতে এতো সঙ্কোচ কেন ? হামলাকারী অস্ট্রেলিয়ান বংশোদ্ভূত শ্বেতাঙ্গ বলে? মিডিয়ায়
বর্তমানে একটা প্রবণতা চালু আছে। কোন আক্রমণকারী যদি মুসলিম হয় তাকে ‘জঙ্গি’ ,‘সন্ত্রাসী’
হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এবং ইসলাম ধর্মকে সামনে টেনে আনা হয়। তারা ইঙ্গিত করতে চায় ইসলাম সন্ত্রাসবাদের ধর্ম। অথচ ব্রেন্টন ট্যারেন্টের ক্ষেত্রে একবারও ধর্মের প্রশ্ন আসেনি।পশ্চিমা মিডিয়ার
প্রোপাগাণ্ডায় বিশ্বের মানুষদের মনে ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে, অধিকাংশ জঙ্গি হামলার সঙ্গে মুসলমানরা জড়িত। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের একটি গবেষণা সংস্থার জরিপে উঠে এসেছে- গত ১০ বছরে দেশটিতে শতকরা ৭১ ভাগ হামলার ঘটনার
সঙ্গে জড়িত শ্বেতাঙ্গ বর্ণবাদীরা। আর মুসলমানরা জড়িত ২৬ শতাংশ হামলার সঙ্গে।
ট্যারেন্টের হামলায় সবচেয়ে যে বিষয়টি আকর্ষণ করেছে সেটা হল বন্দুকের
গায়ের লেখাগুলো। গুগল সার্চ করে
সেই লেখাগুলোর নির্ভরযোগ্য ইতিহাস খোজার চেষ্টা করেছি। ট্যারেন্টের বন্দুকের নলে বড় করে লেখা ছিল ‘রিফুঊজিস ওয়েলকাম টু হেল’। এটি দিয়ে সে মুসলিম অভিবাসীকে
ইঙ্গিত করছে। বন্দুকে Alexandre
Bissonnette নামে ২৯ বছর বয়সী
একজন রাজনীতি নিয়ে পড়া শিক্ষার্থীর নাম লেখা ছিল। ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে কানাডার কিউবেক সিটির একটি মসজিদে
সে হামলা করে যাতে ১৭ এর অধিক লোক আহত ও নিহত হয়। ‘Clavijo 844’ নামে একটা শব্দ লেখা বন্দুকের
বাটে। ক্লভিজো যুদ্ধ একটি পৌরাণিক যুদ্ধ। তাদের মতে, এটি
খ্রিস্টানদের মধ্যে ক্লভিজোর কাছে, অস্টুরিয়াসের রামিরো
প্রথম নেতৃত্বে এবং কর্ডোবা এর আমীর নেতৃত্বে মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা
হয়েছিল।বন্দুকের উপরের অংশ, ম্যাগাজিন ও বন্দুকের
নালে ৪ বার লেখা আছে ‘14’। এটি এডলফ হিটলার ‘মাই ক্যাম্প‘ থেকে নেয়া। যেখানে বলা হয়, আমাদেরকে আমাদের নিজেদের অস্তিত্ব ও আমাদের শ্বেতাঙ্গ
শিশুদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবতে হবে। খেয়াল করলে দেখা যাবে বন্দুকের গায়ে Battle of Tours, ৭৩২, ও Charles Martel ইংরেজিতে লেখা রয়েছে। এই যুদ্ধের পর আরবরা আর মুসলিম সাম্রাজ্য বাড়াতে পশ্চিম
দিকে আসেনি। ফ্রান্সের খ্রিস্টান সাম্রাজ্যের Charles Martel এর নাম লেখা ছিল। ট্যুরিজমের যুদ্ধে অ্যাকুইটিনে একটি আরব অভিযান পরাজিত করার
ক্ষেত্রে তার সাফল্যকে অনেক মনোযোগ দেওয়া হয়েছে।
‘বৈশ্বিক সন্ত্রাস সূচক ২০১৮’ এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ‘২০১৩ সাল থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে (সারাবিশ্বে)
উগ্র-ডানপন্থি দল ও ব্যক্তিরা ১১৩টি সন্ত্রাসী
হামলা চালিয়েছে। শুধুমাত্র ২০১৭
সালেই হামলা হয়েছে ৫৯টি। আর সংস্থাটির
হিসাবে সেসব হামলার অধিকাংশই পরিচালিত হয়েছে “মুসলিমবিরোধী ভাবাবেগে আক্রান্ত উগ্র-ডানপন্থি
শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা।
ট্যারেন্টের ঘটনার রেষ কাটতে না কাঁততেই ২০ তারিখ রাতে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের পাঁচটি মসজিদে হামলা চালিয়েছে
অজ্ঞাত অস্ত্রধারীরা। সবকিছু
বিশ্লেষণ করলে ইউরোপ,আমেরিকায় দৃশ্যমান মুসলিমবিদ্বেষী
নতুন সন্ত্রাসবাদের যে উত্থান হয়েছে তা
স্পষ্ট। । সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা মোড়লরা কী এর পরও চুপ করে থাকবেন।
নাকি নিজের ধর্মের, বর্ণের সন্ত্রাসীকে
ছাড় দেওয়ার সুযোগ আছে? ডোনাল্ড ট্রাম্প ট্যারেন্টের ঘটনায় বলেন, ‘এরা ছোট্ট একটি গ্রুপ।
আমি সত্যিই মনে করি না এরা বিশ্বের জন্য হুমকি’। আসলেই কি শ্বেতাঙ্গ
শ্রেষ্ঠত্ববাদীর সন্ত্রাসবাদ বিশ্বের জন্য হুমকি নয়?
http://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinion/39422/%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8-%E0%A6%93-%E0%A6%B8%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%A4%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A7%80%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A7%8B%E0%A6%A8%E0%A7%8B-%E0%A6%A7%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE-%E0%A6%A8%E0%A7%87%E0%A6%87?fbclid=IwAR2DBw4DrREnMXw57JFqnkQmIH2EVnAD7T2HWYklWSWfmZBQOhuS0WOPL04
লেখক, শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান
বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন