আসামের এনআরসি সমস্যার নেপথ্যে ?
মোঃ শফিকুল ইসলাম।
দীর্ঘদিন অমীমাংসিত স্পর্শকাতর কোন বিষয় নিয়ে একটি রাষ্ট্র যখন বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেয় ঠিক তখন আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে সেটি একটি ভাবনার বিষয় বস্তুতে পরিণত হয়। আর এটা যদি ধর্ম সংক্রান্ত
ব্লকে
হয় তবে ভাবনাটা একটু বেশি কারন এর প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ প্রভাব প্রতিবেশী দেশগুলোতেও পড়ে। ভারতের উত্তর-পূর্বসীমান্তের রাজ্য আসাম। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাজ্যের মধ্যে আসামের অবস্থান দ্বিতীয়। আসাম একসময় বাংলার সঙ্গে যুক্ত থাকার কারনে বাংলাদেশের মানুষের সাথে এই জনগোষ্ঠীর রয়েছে নিবিড় যোগাযোগ। ভারতের নাগরিকত্বের প্রশ্নে আসাম জনগোষ্ঠীর ব্যাপারে ভয়ংকর এক সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।
সম্প্রতি আসামে জাতীয় নাগরিকপঞ্জি ‘ন্যাশনাল
রেজিস্টার
অব সিটিজেনস’ (এনআরসি) চূড়ান্ত তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। জাতীয় নাগরিকপঞ্জীর তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ১৯ লক্ষ ৬ হাজার ৬৫৭ জনের নাম। ৩ কোটি ৩০ লক্ষ ২৭ হাজার ৬৬১ জন আবেদনকারীর মধ্যে এনআরসি তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন ৩ কোটি ১১ লক্ষ ২১ হাজার ৪ জন। নাগরিকপঞ্জী থেকে বাদ পড়াদের আপিল করার জন্য ১২০ দিন সময় দেয়া হয়েছে এতে যারা প্রমান করতে পারবে তাদের কি হবে ? এই এনআরসি হলো একটা ছাঁকনির মত। যারা ছাঁকনিতে আটকে যাবে তারা বিদেশি আর যারা নিচ থেকে বের হবে তারা খাঁটি ভারতীয়।
এনআরসির পিছনে প্রধান যুক্তি হল ভারতের রিসোর্স খুবই লিমিটেড কিন্তু অবৈধ অভিবাসির কারনে তাও ভোগ করতে পারছে না তারা। তাই অবৈধ অভিবাসি দেশ থেকে বের করে দিতে হবে।
![]() |
দৈনিক_আজকালের_খবর। SEP 10, 2019 |
ভারতীয় নাগরিক প্রমানের জন্য ৩ টি শর্ত আরোপ করা হয়েছে। প্রথমত, তারা আসামের বাসিন্দা। দ্বিতীয়ত, তারা ভারতের অন্যান্য রাজ্য থেকে এসেছে অথবা অন্য কোন দেশ থেকে এসেছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ থেকে নয়। তৃতীয়ত, যদি বাংলাদেশ থেকে আসে তাহলে ২৪ মার্চ ১৯৭১ সালের আগে এসেছে তা প্রমান করতে হবে। এই ৩ টির যেকোনো একটি ডকুমেন্ট দিয়ে প্রমান করতে পারলেই মিলবে এনআরসি তালিকায় ঠাঁই।
এখানে প্রশ্ন দাড়াচ্ছে এ নিয়ে এতো কথাবার্তা কিংবা তর্ক-বিতর্ক কেন? আগেই বলেছি এনআরসি একটা ছাঁকনির মত। যেখান থেকে বহিরাগতদের ছেঁকে আলাদা করা হচ্ছে। এই ছাঁকনিটা সঠিক ভাবে কাজ করবে বা করছে কিনা সেটা নিয়েও অনেক প্রশ্ন রয়েছে। গতবছর যখন এই তালিকার ড্রাফ করা হয় তখন ৪০ লক্ষ মানুষ তালিকা থেকে বাদ পরে। এই ঘটনার পর ২৫ জন আত্মহত্যা করে এবং ডিটেনশন ক্যাম্পে মারা যায় আরও ১৫ জন।
ভারতের সামরিক বাহিনীতে ৩০ বছর চাকরি করা সানাউল্লাহকে বহিরাগত সনাক্ত করা হয়। দেশটির ৫ম
রাষ্ট্রপতির
ভাই জায়নুল আলী আহমেদ যিনি ইন্ডিয়ান আর্মি থেকে কর্নেল হিসেবে অবসর নিয়েছেন তার ছেলেও বিদেশি হিসেবে সনাক্ত হয়েছে।
আসামের পরে পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিক
পঞ্জী তৈরি করার ঘোষণা করেছে ভারতের ক্ষমতাসীন বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্ব । দিল্লিতে রাজ্য নেতৃত্বের সঙ্গে দলের সভাপতি অমিত শাহের সঙ্গে
এক বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনাও হয়েছে। ১২ সেপ্টেম্বর দিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে রাজ্য বিজেপির সভাপতি দিলীপ
ঘোষ বলেন, ‘পশ্চিমবঙ্গে এনআরসি হবেই। তাতে প্রায় দুই কোটি মানুষ বাদ যাবে। বিদেশি নাগরিকরা এসে রাজ্য তথা দেশের সম্পদ নষ্ট করছে। তা রুখতেই এনআরসি প্রয়োজন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী বার বার বলে আসছেন
যে তার রাজ্যে তিনি এনআরসি হতে দেবেন না।
পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্যিক, নাট্যকার, গায়ক বা চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্ব
যেসব মানুষ পূর্ববঙ্গ থেকে চলে এসেছিলেন, তাদের অনেকেই বলছেন
এনআরসি হলে নাগরিকত্ব প্রমাণের বৈধ নথি যোগাড় করতে তাদেরও বেগ পেতে হবে।
বিবিসি বাংলাকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে সাহিত্যিক
শীর্ষেন্দু মুখার্জি বলেন, "কবে সীমানা পেরিয়েছি, সেটা তো আমার স্মৃতিতে আছে। কোন স্কুলে কতবছর পড়েছি, সেটাও আমার মনে আছে। কিন্তু এসবের যদি কাগজপত্র দিতে বলে, তা তো দিতে পারব না! তাকে
কী আমাকে বার করে দেবে? সেটাই বা আমি মানব কেন? আর আসামে তো দেখছি, অনেকে বৈধ কাগজপত্র জমা দেওয়ার পরেও
তাদের নাম বাদ দিয়ে দিয়েছে,"
বরিশালের ব্রজমোহন কলেজে পড়াশোনা করেছেন সাহিত্যিক মিহির সেনগুপ্ত। ১৯৬৩ সালে ভারতে চলে আসেন তিনি।
পশ্চিমবঙ্গে জাতীয় নাগরিক পঞ্জী তৈরির ব্যাপারে বিজেপির ঘোষণায়
উদ্বিগ্ন হয়ে বিবিসি বাংলাকে মিহির সেনগুপ্ত জানান "এদেশে ( ভারত) চলে আসার পরে আমি সিটিজেনশিপ সার্টিফিকেট করিয়েছিলাম মূলত পাসপোর্ট বানাতে
হবে বলে। কিন্তু সেই সার্টিফিকেট
এখন কোথা থেকে খুঁজে বার করব ৭৩ বছর বয়সে।"
১৯৭১ সালের ডকুমেন্ট এতদিন পর সবার পক্ষে হয়তো দেয়া সম্ভব হবে না। যারা ভারতীয় নাগরিক হয়েও সর্বোচ্চ রকমের চেষ্টা করেও নিজেদের ভারতীয় প্রমান
করতে
পারবেন না তাদের ভবিষ্যৎ কি হবে ? ভারতের পপুলার নোশন হলো তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দাও। আগেই বলেছি ১৯৭১ সালে নির্যাতিত ও আতঙ্কিত বাংলাদেশীরা অনেকেই আসামপাড়ি দিয়েছিলেন। যদিও তারা দেশে ফিরে এসেছে কিন্তু সেখানে যে অল্প কিছু রয়ে গেছে তা অস্বীকার করা যাবেনা। এই ব্যাপারে যখন কথা উঠেছিল তখন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা গওহর রিজভী বলেছিলেন, ‘যদি ভারত প্রমান করতে পারে তারা বাংলাদেশী তাহলে ফেরত নেয়া হবে’। টেকনিক্যাল ভাবে বাংলাদেশ ফেরত নিতে চাইলেও বাস্তবে কোন ভাবেই সম্ভব না। কারন বর্তমানে এই দেশটি ১১ লক্ষ রোহিঙ্গার বোঝা বহন করছে। ভারতের পাকিস্তান-চায়না সীমান্তে উত্তেজনা চলছে এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ আসাম সীমান্তে নতুন এক সমস্যায় জড়ানো বুদ্ধিমানের কাজ হবে না নিশ্চয়ই।
বহিরাগতদের কি করা হবে এই পপুলার নোশনের পাশাপাশি আরও ২ টি কথা শোনা যাচ্ছে। বহিরাগতদের ডিটেনশন ক্যাম্পে রাখা হবে অথবা দেয়া হবে নাগরিকত্ব সংশোধন বিল। যে বিলের মাধ্যমে বহিরাগতদের একাংশ শরণার্থী হিসেবে গ্রহন করা হবে আর একাংশ করা হবেনা এবং এই বিলে নির্দিষ্ট একটি ধর্মের ( ইসলাম) লোক বাদ দেয়া হবে।
১৯৫৫ সালে পাস হওয়া নাগরিকত্ব বিলের সঙ্গে সংশোধিত বিলের বিশেষ তফাৎ কিছুই নেই। বিলে যা আছে তা ব্যাখ্যা করলে বলা যায় বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তান থেকে ভারতে যাওয়া মুসলমানরা যেমন বেআইনি অনুপ্রবেশকারী, অন্যদিকে ওই তিন দেশ থেকে যাওয়া হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈন, পার্শি, শিখ বা খ্রিস্টানদের মতো ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা হলেন শরণার্থী। বিলে বলা হয়েছে, ভারতের সরকার প্রতিবেশী দেশ থেকে আসা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের আশ্রয় দেবে। কারন তারা বিপদের মুখে নিজের দেশ ছেড়ে পালিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ফেরত পাঠানো হবে কারন সীমান্তের ওপার থেকে রোজগার বা বাসস্থান খুঁজে পেতে কিংবা কোনো অসৎ উদ্দেশ্য নিয়েই তারা ভারতে গিয়েছে। তবে বাংলাদেশ, পাকিস্তান বা আফগানিস্তানের সংখ্যালঘুরা যারা গত এক বছর ভারতে রয়েছেন বা শেষ ৬ বছর ধরেই সেখানে রয়েছেন, তারাই নাগরিকত্ব আইনের(বিল আইন হিসেবে পাস হয়ে যাওয়ার পর) আওতায় নাগরিক হতে পারবেন।
ঐতিহাসিক ভাবে আসামের নাগরিকত্বের প্রশ্নে ‘১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি’ এবং ‘১৯৭১ সালের ২৪ মার্চ’ তারিখ দুটি
খুব
গুরুত্বপূর্ণ। বিদেশিদের চিহ্নিতকরণ, ভোটাধিকার রদ এবং নির্বাসনের দাবিতে অল আসাম স্টুডেন্টস ইউনিয়ন ও অল আসাম গণসংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের ফলে আসাম এবং তৎকালীন রাজীব গান্ধী সরকারের
মধ্যে
অসম
চুক্তি
স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে ১৯৮৬ সালে নাগরিকত্ব আইনে পরিবর্তন এনে আসামের নাগরিকদের জন্য একটি বিশেষ বিভাগ তৈরি করা হয়। ভারতীয় নাগরিকত্ব আইনের নতুন ৬-এ ধারায় বলা হয়, ভারতীয় বংশোদ্ভূত যারা ১৯৬৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যে ভারতে এসে সাধারণ বাসিন্দা হিসেবে রয়ে গেছেন তারা বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত হবে। বিদেশি চিহ্নিত করা হবে বেআইনি অনুপ্রবেশকারী আইন অনুসারে যা কেবল আসামের জন্য প্রযোজ্য। যারা ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর পর আসামে এসেছেন তাদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে না। ১৯৭১সালে নির্যাতিত ও আতঙ্কিত বাংলাদেশীরা অনেকই আসাম পাড়ি দিয়েছিলেন। এনআরসি’র লক্ষ্য হচ্ছে অনুপ্রবেশকারী মুসলিমদের শনাক্ত করে তাদের বহিষ্কার করা।
পঁয়তাল্লিশ কোটি টাকা বাজেটে আসামের গোয়াল পাড়ায় নির্মিত হচ্ছে ভারতের প্রথম ‘ডিটেনশন ক্যাম্প’। নাগরিকত্ব তালিকা থেকে বাদপড়া রাষ্ট্রহীন মানুষের জন্য আসাম জুড়ে এরকম আরো এগারোটি ক্যাম্প হওয়ার কথা রয়েছে।
বিজেপির রাজনৈতিক গেইম পরিষ্কার। বাংলাদেশ থেকে যাওয়া হিন্দুদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করা গেলে তারা আজীবন বিজেপির ভোটব্যাংক হয়ে থাকবে। আর মুসলমানদের তাড়ানো গেলে বিরোধী ভোট কমে যাবে।
যারা নিজেদের ভারতীয় হিসেবে প্রমান করতে পারবেনা এবং শরণার্থী হিসেবেও ভারত তাদের গ্রহন করবে না তাদের ভবিষ্যৎ কি
? তাদের
ভাগ্য রেখা রোহিঙ্গাদের সাথে এক সূত্রে গাঁথা নয়তো? জানতে হলে অপেক্ষা করতে হবে।
বন্ধু রাষ্ট্রের ক্ষমতাসীন দলের সভাপতির মুখ থেকে যখন এই কথা
আসে এরা
বাংলাদেশের অনুপ্রবেশকারী৷ উইপোকার মত তাদের বঙ্গোপসাগরে ডুবিয়ে দেয়া হবে৷ তখন বাংলাদেশের
একদম চুপ থাকা সমীচীন মনে করি না।
আসাম ও কাশ্মিরের ঘটনা প্রমাণ করে বিজেপি সরকার কট্টর হিন্দুত্ববাদী
এজেন্ডা বাস্তবায়নে শক্তি প্রয়োগের নীতি অবলম্বন করছে এবং ভারতকে হিন্দু রাষ্ট্র হিসেবে
প্রতিষ্ঠা করতে চায়। রাজনীতির পক্ষে-বিপক্ষের লোকেরা বলছেন, আসাম ও কাশ্মির ইঙ্গিত দেয় আগামী দিনে ১.৩ বিলিয়ন ভারতীয়
জনগণকে কোন পথে নিয়ে যেতে চাইছেন মোদি। তিনি একটি বিপজ্জনক খেলা শুরু করছেন। তিনি ভারতের শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্য ভেঙে ও সামাজিক বিচ্ছেদ
তৈরি করছেন। মোদির রাজনৈতিক
শেকড় কট্টরপন্থী হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের গাঁথা। আরএসএস সবকিছুর ঊর্ধ্বে হিন্দু ধর্মকে স্থান দেয়। তাদের এই বিশ্বদৃষ্টিভঙ্গির ফলে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ও মুসলিম
সংখ্যালঘুর ভারতে বেশ কয়েকটি ধর্মীয় দাঙ্গার সূত্রপাত হয়েছে এবং এনআরসির ঘটনায় নতুন
করে ধর্মীয় দাঙ্গা লাগবে
তাতে কোন সন্দেহ নাই।
Slots, Slots, Poker, Table Games - Mapyro
উত্তরমুছুনView Slots, Slots, 영천 출장샵 Poker, Table Games, Scores, 제주 출장마사지 Phone numbers and 세종특별자치 출장샵 reviews. MapYR Traffic RankCity (New 제주도 출장안마 York)12602483,8160310,038,0026,00863View 28 more rows 1xbet app