নারীদের কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার।
শফিকুল ইসলাম
সাধারণত শিশুর ব্যক্তিত্ব গড়ে ওঠে প্রথম ছয় বছরে। এই সময়টাতে তাদের যথেষ্ট ভালোবাসা আর মনোযোগ দরকার। প্রথম বছরে শিশুর মধ্যে অনুভূতি জন্মলাভ করে। দ্বিতীয় বছর থেকে তার শব্দ ভাণ্ডার সমৃদ্ধ হতে থাকে। তৃতীয় বছরে বাচ্চারা অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময় করতে শেখে। চতুর্থ বছর থেকে ধীরে ধীরে তারা হয়ে ওঠে আত্মনির্ভরশীল। পঞ্চম আর ষষ্ঠ বছরে বাচ্চারা নিজেদের চাওয়া-পাওয়াগুলো তুলে ধরতে শেখে। এ সময় নিজেদের আবেগ-অনুভূতিগুলো আরো ভালোভাবে প্রকাশ করতে শেখে। পরিবেশ আর ব্যক্তিত্বভেদে শিশুদের বেড়ে ওঠার গতি নির্ভর করে। শিশুরা সাধারণত প্রথম পর্যায়গুলো মায়ের সঙ্গে বেশি সময় কাটায়। অনুভূতি সংক্রান্ত চাহিদা তিনিই পূরণ করেন। এই সময়টা শিশুদের ‘কোয়ালিটি টাইম’। তাদের বেশি সময় দিতে হয়, যত্নও নিতে হয়।
নারীশিক্ষার্থী ও কর্মজীবী নারী, যাদের শিশুসন্তান রয়েছে, তাদের জন্য কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার বা শিশুদিবাযত্ন কেন্দ্র খুবই প্রয়োজন। জন্মের পর প্রথম ছয় মাস শিশুরা শুধু মায়ের দুধ খায়। ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত অন্য খাবারের পাশাপাশি শিশুকে বুকের দুধও দিতে হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকলে নারীরা সহজেই তাদের শিশুকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন। দিবাযত্ন কেন্দ্র নারীর ক্ষমতায়নের সঙ্গেও জড়িত। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীর শিক্ষা, নারীর উপার্জন, নারীর সুস্বাস্থ্য, ঘরে ও বাইরে নারীর জ্ঞান ও দক্ষতা চর্চার অনুকূল পরিবেশ থাকাও জরুরি। শুধু সন্তান লালন-পালন করার জন্য অনেক মাকে কর্মক্ষেত্র ছেড়ে দিতে হয়।
নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন, উন্নততর কর্মপ্রত্যাশা, সর্বোপরি উন্নত শিক্ষা এবং তাদের অধিকার আদায় সম্বন্ধে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। নারীর ক্ষমতায়ন ও কর্মক্ষেত্রে নারীর দক্ষতা চর্চার জন্য বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেসব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর শিশুসন্তান আছে, তাদের জন্য ডে-কেয়ার সেন্টার চালু করেছে। সেন্টারগুলোতে শিশুদের জন্য থাকা, খাওয়া, ঘুম, প্রাথমিক চিকিত্সা, খেলাধুলা ও বিনোদনের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের খুবই ভালো একটি উদ্যোগ। আমাদের দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রতিষ্ঠানে এরকম ডে-কেয়ার সেন্টার থাকা খুবই জরুরি। কিন্তু আমাদের দেশের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানেই ডে-কেয়ার সেন্টার নেই। অথচ প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে শুরু করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, চিকিত্সা, শিক্ষকতাসহ বিভিন্ন পেশা ও উত্পাদনশীল খাতে বহু নারী কাজ করছেন। বাংলাদেশ সরকার শ্রম আইন-২০০৬-এর সংশোধনীতে ৯৮ ধারায় শিশু-কক্ষবিষয়ক আইন যুক্ত করা হয়। যাতে বলা হয়েছে, একটি অফিসে ৪০ জন বা এর বেশি মহিলা থাকলে এবং তাদের ছয় বছরের কম বয়সি শিশুসন্তান থাকলে তাদের সুবিধার্থে কর্মক্ষেত্রে একটি শিশু-কক্ষ স্থাপন করতে হবে। কিন্তু এ আইন মানছে খুব কম প্রতিষ্ঠান। তাই শিশুসন্তানের দেখভালের জন্য নারীদের বাড়ির অন্য সদস্যের ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেক ক্ষেত্রে শুধু গৃহকর্মীর ওপর নির্ভর করতে হয়। অনেক সময় দেখা যায়, এসব গৃহকর্মী বিশ্বস্ত নন। তারা শিশুর দেখাশোনা ঠিকমতো করেন না। তখন সন্তানদের জন্য দুশ্চিন্তায় কাজে মনোযোগ দিতে পারেন না কর্মজীবী মায়েরা। কাজের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। সন্তানের দেখভালের জন্য অনেক শিক্ষিত ও যোগ্য নারী বাধ্য হয়ে চাকরি ছেড়ে দিচ্ছেন। একইভাবে শিক্ষার্থী মায়েরা ক্লাসের পড়ালেখায় মন দিতে পারেন না। তাদের পড়ালেখায় ব্যাঘাত ঘটে। তাই কর্মস্থলে ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডে-কেয়ার সেন্টার থাকাটা খুব জরুরি। কর্মজীবী নারীর সংখ্যা বাড়াতে এবং নারীদের কর্মক্ষেত্র ধরে রাখতে হলে কর্মস্থলে ডে-কেয়ার সেন্টার গড়ে তোলার কোনো বিকল্প নেই।
বতর্মানে বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, সরকারি-বেসরকারি অফিস থেকে শুরু করে সকল কর্মক্ষেত্রে বিরাট একটা অংশই নারী। একজন নবজাতকের জন্য মায়ের পরম স্নেহ, মমতা, ভালোবাসা আর আদর-যত্ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যা তার সুস্থ এবং স্বাভাবিকভাবে বেড়ে ওঠার জন্য অপরিহার্য। মা হিসেবে একজন শিক্ষার্থী বা শিক্ষক যখন তার সন্তানের দেখাশোনায় আত্মনিয়োগ করেন তখন তার পক্ষে আর স্বাভাবিকভাবে পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা কিংবা নিয়মিত ক্লাসে পাঠদান করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। তাই প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডে-কেয়ার সেন্টার আবশ্যক বলে মনে করি। জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে নারীদের অংশগ্রহণ এবং রাষ্ট্র ও জনজীবনের সর্বস্তরে নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করুক এই প্রত্যাশা সবারই।
২৪ সেপ্টেম্বর ২০১৯ দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশ হয়।
https://www.ittefaq.com.bd/print-edition/opinion/91073/%E0%A6%A8%E0%A6%BE%E0%A6%B0%E0%A7%80%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B0-%E0%A6%95%E0%A6%B0%E0%A7%8D%E0%A6%AE%E0%A6%B8%E0%A7%8D%E0%A6%A5%E0%A6%B2%E0%A7%87-%E0%A6%A1%E0%A7%87-%E0%A6%95%E0%A7%87%E0%A7%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%B8%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%8D%E0%A6%9F%E0%A6%BE%E0%A6%B0?fbclid=IwAR1i05LfyzrxDzdArce5I5zwR4kHVNj2pWrFZNATFov3uW8kENoQQZb4Y_A
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন