নির্বাচনঃ ধর্মের রাজনীতি, রাজনীতির ধর্ম।
নির্বাচনঃ ধর্মের রাজনীতি, রাজনীতির ধর্ম।
ধর্মের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হলেও বাঙালীদের বুঝতে ২৪ বছর সময় লেগেছে তারা স্বাধীন হয়নি। বাঙালীরা বুঝেছিল ওয়ান ক্যান নট লিভ অনলি বাই রিলিজিয়ন। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পর খসড়া সংবিধানের প্রস্তাবনায় সন্নিবেশিত করেছিল - “পবিত্র কুরআন শরীফ- পবিত্র সুন্নাহ বিরোধী আইন পাস করা হবে না” (দ্রষ্টব্যঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত,২য় খ-,পৃ.৭৯৪)। ১৯৭১ সনে মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রে সংবিধানের ৩৮ ধারায় ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার নিষিদ্ধ হয়। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সংবিধানে "বিসমিল্লাহ" সংযোজন করে ধর্মেকে রাজনৈতিক অঙ্গনে সামনে নিয়ে আসেন। এরপর স্বৈরশাসক এরশাদও ইসলামকে "রাষ্ট্রধর্ম" বানিয়ে ভোটারদের টার্গেট করে ক্ষমতা সুসংহত করার চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক অঙ্গনে ধর্ম ও ধর্মীয় দলগুলো নতুন শক্তিতে আবির্ভাব শুরু হয়।
পৃথিবীতে ধর্মের আবির্ভাবের পর থেকেই সাধারণ মানুষকে নিয়ন্ত্রিত করার জন্য এর রাজনৈতিক ব্যবহার (বা অপব্যবহার) হয়ে আসছে। অ্যান্থনী মাসকারেণহাস তার " দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ " গ্রন্থে লিখেছেন " আমি বাঙালী মুসলমানের অন্যত্র বসবাসকারী মুসলমানদের চেয়ে বেশি ধর্মভীরু দেখেছি "। আসলেই আমরা বাঙালী মুসলমানেরা খুববেশি দর্মভীরু ও অতিমাত্রায় ইমোশনাল। যেকারণে শাসকরা ধর্মকে ব্যবহার করেন ক্ষমতারোহণের সিঁড়ি হিসেবে।
বাংলাদেশর এমন একটি স্যেকুলার রাষ্ট্রের দাবিদার যেখানে ইসলামপন্থী ও স্যেকুলার সবার নির্বাচনী প্রচারনা শুরু হয় সিলেটে মাজার জিয়ারত করে। সরকার বিরোধী জোট ঐক্যফ্রন্টের ড. কামাল হোসেন থেকে শুরু করে স্যেকুলারিজমের দাবিদার খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও সিলেটে তিন আউলিয়ার মাজার জিয়ারত করে কোরআন তেলাওয়াত শেষে প্রচারনা শুরু করেছেন। আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী প্রচারনায় মাইকে প্রচার করছে " লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, নৌকার মালিক তুই আল্লাহ"। বিএনপি "লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, ধানের শীষে বিসমিল্লাহ"। কেউ প্রকাশ্যে ধর্মীয় এজেন্ডা নিয়ে কেউ স্যেকুলারিজমের আড়ালে ধর্মীয় সেন্টিমেন্ট কাজে লাগিয়ে ভোটব্যাংক ভারীর চেষ্টা করছেন। আর এসবের উদ্দেশ্যে ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠা করা না বরং ইসলামকে ব্যবহার করে ক্ষমতায় যাওয়া।
অনেক দিন ধরে ধারনা আছে ইসলামপন্থী দলগুলোর ভোট ধর্মীয় রাজনীতির আশ্রয়দাতা
বিএনপির পক্ষে বেশি যায় এবং পলিসি তৈরিতে তাদের কথা বিবেচনা করা হয়। কিন্তু
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সেই চেহারা পুরোপুরি বদলেগেছে। ইসলামপন্থী দলগুলোর মধ্যে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি জোটে মাত্র ৫ টি ইসলামী দল আছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী জোট ও মিত্র ১৪ দলে ২৯ টি এবং জাতীয় পার্টিতে ৩৪ টি সহ মোট ৬৩ টি ধর্মভিত্তিক দল আছে। ৭০ টি ইসলামীপন্থী দলের ৬৩ টি আওয়ামী মহাজোটের সাথে। যা মোট ইসলামী দলের ৯০ শতাংশ। এর মধ্যে
কট্টর হিন্দু বিদ্বেষী দলও রয়েছে। এর বাইরেও আওয়ামী লীগের সাথে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের সরকারি স্বীকৃতি দেয়ার পরে হেফাজত ইসলামের সাথে সখ্যতা গড়ে উঠেছে। যা ভোটব্যাংক ভারী করবে।
বাংলাদেশের ভোটের রাজনীতিতে ধর্ম, বিশেষ করে ইসলাম একটি বড় ‘ফ্যাক্টর'। তাই যে যার মত করে এর ব্যবহার করছে। কুড়িগ্রামে জামায়াত মতাদর্শী মাদ্রাসার শিক্ষক "নামাজ যেমন ফরজ তেমন ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীদের ভোট দেয়াও ফরজ কাজ" এমন বক্তব্য দিয়েছেন। বরিশাল সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে চরমোনাইপীর বলেছিলেন "হাতপাখায় ভোট দিলে নবীকে ভোট দেয়া হবে"। ধর্ম ভিত্তিক দলগুলোর ইসলাম কেন্দ্রীক কথাবার্তা বলবে কারন তাদের গঠনতন্ত্র ধর্মকে ভিত্তি করে। কিন্তু সেই কথাবর্তা কতটা যুক্তিযুক্ত সে ব্যাপারে জবাবদিহিতার প্রয়োজন রয়েছে। ধর্মের অপব্যবহারে স্যেকুলার আওয়ামী লীগও পিছিয়ে নেই। সিলেটে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, ‘নূহ নবীর নৌকার মতো আওয়ামী লীগের নৌকা মানুষের বিপদে এগিয়ে এসেছে’। এর আগেও তিনি বলেছিলেন " মদিনা সনদ অনুযায়ী দেশ চলছে "। আওয়ামী লীগের অনেকের নামের পূর্বে আলহাজ্জ্ব বিশেষণ যুক্ত পাঞ্জাবী, টুপি পড়া ছবির পোষ্টার রাস্তায় রাস্তায় শোভা পাচ্ছে। মুসলিম মেজরিটিকে কাছে টানতেই যে এসব করা হচ্ছে। উদার সংস্কৃতিমনা, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীলতার দাবিদার বাম নেতারাও এবছর পাঞ্জাবি-টুপি পড়ে ধর্মীয় লেবাসে নির্বাচনী প্রচারনায় নেমেছেন যা কিনা নিজেদের আদর্শের খেলাপ। যারা ভোটের আগে ধর্ম বিরোধী কথা বলতো তারাই এখন ধর্মীয় লেবাসে ভোট চাইতে নেমেছে। রাজনীতিতে ধর্মকে হাতিয়ার বানানো বিপদজনক। এটা জনগনেকে শুধু ধোঁকা নয় প্রতারনার সমান গন্য করা যায়।
বাংলাদেশে ধর্মীয় রাজনীতি বলতে ইসলামের নামে রাজনীতি বোঝায়, এবং এই ক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর নামই আসে প্রথম। তারপরে চরমোনাইপীরের "ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ"। ধর্মীয় বিবেচনায় এই দুই দলই মাঠে ভালো জনপ্রিয়। ইসলামী আন্দোলন কোন আসন না জিতলেও তারা
মেয়র ইলেকশনে রেকর্ড সংখ্যক ভোট পেয়েছে। জামায়াত ১৯৯১ সনে সর্বোচ্চ ১৮ টি আসন পেয়ে মন্ত্রী হওয়ারও রেকর্ড রয়েছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন ও ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধের কারনে বর্তমানে দলটির নিবন্ধন বাতিল হওয়ায় ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন করছে। জামায়াত নেতাদের যুদ্ধাপরাধের শাস্তি দেয়ার পরেও দলটি নিষিদ্ধের প্রধান দুটি কারণ থাকতে পারে। (যেহেতু ধর্মভিত্তিক দল হওয়া সত্ত্বেও চরমোনাইপীরের ইসলামী আন্দোলনকে নিষিদ্ধ করা হয়নি)। এক, মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের বিতর্কিত অবস্থান। দুই, ইসলামপন্থী গনতান্ত্রিক শক্তির পক্ষে দিন দিন জনসমর্থন বৃদ্ধি পাওয়া। ইসলামপন্থী দলগুলোর ৯০ শতাংশ আওয়ামী লীগ তার মহাজোটে নিয়ে আসা এর যথার্থতা প্রমান করে।
২০১৫ সালে প্রকাশিত যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিক ইনস্টিটিউট (আইআরআই) এর জরিপে দেখা যায় বাংলাদেশ ইসলামপন্থীদের পক্ষে জনসমর্থন বাড়ছে। ঠিক এই কারনেই যদি ক্ষমতাসীন ধর্মনিরপেক্ষ আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য ইসলামী দলগুলোকে কাছে টেনে থাকেন তাহলে ভয়ের কারণ আছে। এটা তাদের স্যেকুলার আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। হেফাজতের সাথে সখ্যতা গড়ার আগেই তাদের গ্রীক মূর্তি অপসারণ, পাঠ্যপুস্তকে পরিবর্তনসহ কওমি সনদের স্বীকৃতির দাবি সরকার মেনে নিয়েছে এবং হেফাজতের আপত্তির কারণে এখনো নারী নীতির বাস্তবায়ন হয়নি। তাই নির্বাচনে যদি জয়লাভ করে তাহলে হেফাজতসহ বাকি ৬৩ টি ইসলামপন্থী দলগুলোর দাবি উপেক্ষা করে পলিসি তৈরি করা যে সম্ভব হবে না, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ক্ষমতাসীন দলের রাষ্ট্রপতি এ্যাডভোকেট আব্দুল হামিদ তার ভাষণে একবার বলেছিলেন, "বাংলাদেশ তার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখবে"। কিন্ত এসব করণে এখন বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে স্যেকুলারিজমের দাবিদার আওয়ামী লীগে কি তার ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বজায় রাখতে পারবে ?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন