প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চাই না।
প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন চাই না।
শফিকুল ইসলাম।
বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিনক্ষণ যত ঘনিয়ে আসছে ভোটারদের উৎসাহ, উদ্দীপনা তত বাড়ছে। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর দীর্ঘ দশ বছর পর ভোটরদের মধ্যে উৎসবের আমেজে সৃষ্টি হয়েছে । কারণ নাগরিক হিসেবে স্বাধীনভাবে ভোটাধিকার প্রয়োগ করতে পারা রাষ্ট্রের অন্যতম নাগরিক স্বীকৃতি। নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী দেশের নেতৃত্ব নির্বাচনে এই একটি দিনের অপেক্ষা করেন সবাই। এবছর ৪ কোটি ২০ লক্ষ তরুণ ভোটার যা মোট ভোটারের ৪০% এর বেশি। তাই তরুণ ভোটাররা বেশ আগ্রহ নিয়েই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। সবারই প্রত্যাশা একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন। ২০১৪ সালের একতরফা ভোটারবিহীন নির্বাচনের পর ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সব রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে প্রতিযোগীতামূলক নির্বাচনে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। তাই কোন ভাবেই যেন এই নির্বাচন পূর্বের ন্যায় বিতর্কিত না হয় সে ব্যাপারে লক্ষ্য রাখতে হবে। কেবল দেশের একটি দল নয় বরং সব রাজনৈতিক দল ও আন্তর্জাতিক মহলেও নির্বাচন গ্রহনীয় হতে হবে। কেননা তা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কম। নির্বাচনে ১৬টি দেশ ও সংস্থার ১৭৮ জন পর্যবেক্ষকের মধ্যে বিদেশি পর্যবেক্ষক থাকবেন ৯৭ জন এবং বিদেশিদের প্রতিনিধি হিসেবে বাংলাদেশী থাকবেন ৮১ জন। দেশীয় পর্যবেক্ষকের মধ্যে ২৫ হাজার ৯২০ জনের তালিকা অনুমোদন করেছে নির্বাচন কমিশন। এই সংখ্যা ২০০৮ সালের নির্বাচনে অংশ নেয়া পর্যবেক্ষকদের ছয়ভাগের একভাগ কম। ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকের সংখ্যা ছিলো ৫৯৩ জন। দেশীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন ১ লাখ ৫৯ হাজার ১১৩জন। ২০০১ সালের নির্বাচনে দেশী পর্যবেক্ষক ছিলেন ২ লাখ ১৮ হাজার এবং বিদেশী পর্যবেক্ষক ছিলেন ২২৫জন। ২০১৪ সালের ৫ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনে বিদেশীদের সংখ্যা ছিলো মাত্র চারজন, দেশীয় পর্যবেক্ষক ছিলেন ৮ হাজার ৮৭৪জন। নির্বাচনে বিদেশী পর্যবেক্ষকদের সংখ্যা দিন দিন কমে যাওয়া বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার ত্রুটি বলে মনে করি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগেই জানিয়ে দিয়েছিল এবারের নির্বাচনে তারা পর্যবেক্ষক পাঠাবে না। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ছাড়পত্র ও ভিসা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় বাংলাদেশ সরকারের প্রতি হতাশা জানিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ফ্রি ইলেকশন (এএনএফআরএল) এর পর্যবেক্ষক ভিসা আবেদন বাতিলে করেছে। বিগত নির্বাচনের তুলনায় এবছর বেশ কড়াকড়ি নিয়ম আরোপ করা হয়েছে। ভিসা জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতা বিদেশী পর্যবেক্ষকদের নিরুৎসাহিত করছে। অথচ আন্তর্জাতিক মহলের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষণ নির্বাচনের ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়িয়ে দেয় এবং অবাধ, সুষ্ঠু নির্বাচনে জনগণের আস্থা তৈরি হয়। যা বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও "গুড গভারনেন্সের'' পথে অন্যতম মাইলফলক হিসেবে কাজ করতে পারে।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রার্থীদের প্রচারণা চলছে। ক্ষমতাসীন দল নির্বিঘ্নে তুমুল প্রচারণা চালালেও বিরোধী দলগুলোকে প্রচারনা করতে বাঁধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে । হামলার শিকার হয়েছেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, বিএনপির মহাসচিবসহ অন্যান্য বাম জোটের নেতৃবৃন্দ। বিভিন্ন জেলায় প্রার্থী, নেতাকর্মী ও গাড়িবহরে হামলা, ভাঙচুর, কর্মী সমর্থকদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। বিরোধী নেতা কর্মীদের ভয়ভীতি প্রদর্শন এবং ভিন্ন মতকে দমনের যে অভিযোগ আসছে তা সুষ্ঠু নির্বাচনে জন্য খুবই উদ্বেগজনক। জাতিসংঘের বিবৃতি মতে, গত ৯ থেকে ১২ ডিসেম্বর ২০১৮ পর্যন্ত ৪৭টি সহিংসতার ঘটনায় আটজন নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন ৫৬০ জন। এটি সুষ্ঠু ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের পরিবেশ নয়।
৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে নির্বাচনী সহিংসতা ও বিরোধী দলীয় প্রার্থীদের গ্রেপ্তারের ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। ‘দমনমূলক পরিবেশ’ বিরাজ করছে বলে মনে করছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ (এইচআরডব্লিউ)। নির্বাচন পূর্ব এ ধরনের মন্তব্য নির্বাচনী প্রক্রিয়ার গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নের মুখে ফেলবে।
অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে সুস্থ প্রতিযোগিতার জন্য যে অনুকূল পরিবেশ প্রয়োজন, তা এখনো সৃষ্টি হয়নি। সারা দেশে বিরোধী প্রার্থীর সমর্থকদের হামলা, আটক ও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। প্রার্থীদের ওপর এসব প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বাধার প্রভাব নির্বাচনে পড়বে। শান্তিপূর্ণ নির্বাচনের জন্য সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি না হলে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও সহিংসতার কারণে স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভোটকেন্দ্রে যাবেন কি না, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। এটি নির্বাচনী ব্যবস্থাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। কারণ, এমনটি চলতে থাকলে চূড়ান্ত ক্ষতির শিকার হবেন ভোটাররা। তাঁরা ভীত ও শঙ্কিত হয়ে পড়বেন। ভোট দিতে যাওয়ার ব্যাপারেও তাঁরা সংশয়গ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন। ভোটাররা যদি অবাধে ভোটকেন্দ্রে না যেতে পারেন, তাহলে সেই নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক বলা যাবে না। সে নির্বাচনকে নিরপেক্ষ নির্বাচন বলা যাবে না।
নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে এ নির্বাচন বাংলাদেশকে আরেকটি সহিংসতার দিকে ঠেলে দিতে পারে। ৫ ই জানুয়ারির বিতর্কিত নির্বাচনের পর বিরোধী দল সারা দেশে মাসব্যাপী যে হারতাল, অবরোধ, অগ্নিসংযোগ শুরু করেছিল সেটা বর্তমানে আরো মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। যার প্রভাব পড়বে দেশের সব অঙ্গনে, বিশেষ করে অর্থনৈতিক ভাবে বাংলাদেশ বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বন্ধ হয়ে যেতে পারে বিদেশী বিনিয়োগ, মুখ থুবড়ে পড়বে পর্যটনশীল্প।
সকল বাধা অতিক্রম করে সুষ্ঠু নির্বাচন একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ভোটকেন্দ্র ও ভোটগ্রহণের পরিবেশ সুষ্ঠু রাখতে এবং নির্বাচনী এলাকায় যে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা রুখতে সরকারী দল, বিরোধী দল, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সকলের অংশগ্রহণে নির্বাচনকে উৎসবমুখর করতে হবে। নির্বাচনে ভোট কেন্দ্রে জনগণের ঢল নামুক। প্রশ্নহীন ভাবে সকল রাজনৈতিক দলের কাছে গ্রহনীয় হোক নির্বাচন। সবার স্বাধীন ভোটাধিকার প্রয়োগের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠিত হোক। টেকসই উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক বাংলাদেশ।
শিক্ষার্থী, রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন