পাঠশালায় নামাজ পড়া শেখান হিন্দু শিক্ষক

বিশ্ব শিক্ষক দিবস। সত্যি কথা বলতে শিক্ষকদের কোন দিবস হয় না। মা-বাবা শুধু আর্থিক সাহায্যের পাশাপাশি নীতি, নৈতিকতা, সমাজের মূল্যবোধ শেখান ঠিকই কিন্তু পরিপূর্ণ মানুষ  হিসেবে গড়ে তোলেন একজন শিক্ষক। তাই মস্তিষ্কের প্রতিটি নিউরনে ধারন করি আপনাদের।💓

আমার পাঠশালার ছোট্ট এক গল্প বলি।

শ্রদ্ধেয় দিলিপ কুমার স্যার।আমার পাঠশালার হিন্দু ধর্মাবলম্বী  শিক্ষক।তিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করতেন না।তার প্রধান আয়ের উৎস ছিল পুরনো হাড়ি-পাতিল, কলসি,  ডায়নেমা, ঠোঙ্গা ইত্যাদি মেরামত করা।পাশাপাশি পাঠশালাও চালাতেন।প্রথমে স্যার আমাদের তিন খালাতো ভাইকে বাসায় এসে পড়াতেন। পরবর্তীতে আস্তে আস্তে গ্রামের কাচারি ঘরে  পাঠশালা করা হয়।গ্রামের সবথেকে ছোট ছোট বাচ্চারা আসতে শুরু করে।খুব অল্পদিনেই ছাত্র ছাত্রীর সংখ্যা বাড়তে থাকে।কারণ একটাই,তার কাছে যারা পড়তো তারা ক্লাসে সবার থেকে ভালো করতো।আমরা পাঠশালায় বসেই ক্লাসের পড়া শেষ করে আসতাম।বাড়িতে পড়তে হতো না।শুধু হাতের লেখা লিখতাম।

দিলিপ স্যার হিন্দু হলেও পাঠশালা, রাস্তায়, যখন যেখানে দেখা হতো  তাকে সবসময় সালাম দিতে হতো,এর পাশাপাশি রাস্তায় যত মানুষের সাথে দেখা হবে সবাইকেও সালাম দেয়ার নির্দেশনা ছিল।পরবর্তীতে এমন একটা অবস্থা হয়, কোন পথচারীকে সালাম না দিলে সে খবর পৌঁছতো স্যারের কাছে।আর এর জন্য সেই মাপের ধোলাই।তিনি আমাকেও সালাম দেয়া শিখিয়েছেন যা অল্পবয়সে আমার চর্চা ছিল কম,আমাকে নামাজ পড়া শিখিয়েছেনও তিনি।আল্লাহর শানে সেজদা দেয়ার সময় কপালের আগে  নাক মাটিতে লাগাতে হয় কিন্তু বারবার বলার পরেও না পারার কারনে সেই লাঠিপেটার কথা আজও আমার মনে আছে।ঠিকমত দাঁত ব্রাশ করা, হাত পায়ের নক সঠিক সময়ে কাটা,সময় মতো গোসল করা,কেউ  রাস্তাঘাটে বা মা বাবার সাথে দুর্ব্যবহার করেছি কিনা এসব বিষয়ে পাই টু পাই প্রতিদিন তদারকি করতেন।দাঁত একটু লাল থাকলে, নক একটু বড় থাকলে বা একদিন গোসল না করলে তার জন্যও শাস্তি দিতেন।কিন্তু বর্তমান সময়ে এই সব ব্যাপার চিন্তাও করা যায় না।স্যার, হয়তো  আমাকে পরিপূর্ণ নামাজ শেখাননি কিন্তু ছোট বয়সেই আমার মধ্যে এটা পুশ করে দিয়েছেন যে, তোমাকে নামাজ পড়া শিখতে হবে, সালাম কালাম শিখতে হবে, বড়দের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে তাদের সালাম দিতে হবে, মা বাবার সাথে জোর গলায় কথা বলা যাবেনা। মোটকথা তোমাকে হতে হবে একজন আদর্শ মানুষ।

স্যার সবাইকে যেমন ভালোবাসতেন তেমন কঠোর শাস্তিও দিতেন। বর্তমানে সেইসব শাস্তির কথা শুনলে মধ্যযুগীয় বর্বরতা মনে হতে পারে। বেত দিয়ে মারার পাশাপাশি স্যারের শাস্তির ধরন ছিল রশি দিয়ে পা বেধে মাথা নিচে আর পা উপরে  বেঁধে আচ্ছা করে লাঠিপেটা করা, নারিকেল খাওয়ার পরে ভাঙা অংশ দুটোর উল্টো দিক একটু আলপিনের মত থাকে, সেটাকে দা দিয়ে তীক্ষ্ণ তীরের মত করা হয়, তারপর দু পায়ের নিচে দুটো দিয়ে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে পড়তে  হতো  নির্দিষ্ট সময়ের পর যতক্ষণ পড়া দিতে না পারতো ঠিক ততক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। সবগুলোই আমার উপর টেস্ট করা হয়েছে।রশি দিয়ে বেঁধে  টানিয়ে পেটানোর পরে পা, হাটুর নিচের চামরা উঠে গিয়েছিল,তারপর তিন দিন জ্বর ছিল আমার। মা বাবা কেউই কিছু বলেনি। ছোট মামা শুনে স্যারকে মারতে গিয়েছিল কিন্তু তাকে খালু ফিরিয়েছেন।
ক্লাসে কেউ না আসলে তিনি  নিয়ে আসতে বাড়িতে যেতেন।একদিন তার ভয়ে একছাত্র ভাঙা কবরের মধ্যে লুকিয়েছিলো। এই হচ্ছে মোটামুটিভাবে পাঠাশালার কিছু স্মৃতি। আরও অনেক আছে। সেকথা থাক।

এই কথামালার তাৎপর্য কি?
হ্যা, এ্যাতো কিছুর পরেও তিনি আমার একজন আদর্শ শিক্ষক। তাকে আমার জীবনের প্রতি পরতে পরতে মনে করতে হবে। কারণ তিনি আমার মধ্যে কিছু একটা বপন করে দিয়েছেন।একটি সুন্দর মানুষ হওয়ার বীজ বপন করছেন, সেই চক সিলেটের "অ" "আ"  "ক" "খ" হাতেখড়ির সময় থেকে। আমিসহ তিন কাজিন স্যারের কাছে পঞ্চম শেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছি। তারপর আর পড়া হয়নি।কিন্তু আমরা তিনজনই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (বরিশাল, চট্রগ্রাম,ঢাকা) পড়ালেখা করেছি। তিনজনই একমত এই পথচলায় স্যারের অবদান সবচেয়ে বেশী। আমরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাই ঠিক সেই সময়ে ওই গ্রামের কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পায়নি।স্যার ছিলেন মূলত একজন মেকার, প্রতিষ্ঠিত কোন  স্কুলের শিক্ষক না হলেও উচ্চ শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন আমাদের আদর্শ শিক্ষক।এখনও আছেন, ভবিষ্যতেও থাকবেন। আমার সারাজীবনের আদর্শ হয়ে থাকবেন।

ঈদের ছুটিতে যখন বাড়ি গিয়েছিলাম স্যারের দোকানে গিয়ে স্যারকে আমরা চা খাওয়ার অনুরোধ করলাম। স্যারও রাজি হলেন। চা খাওয়ার মধ্যে অন্য দেকানের কাকা এসে বললো, কি মাস্টার তুমি নাকি চা খাওনা?  জোর করেও তো খাওয়ানো যায় না। এখনতো দেখছি খাচ্ছ। স্যার উত্তর দিলেন "চা না খেলে ওরা কষ্ট পাবে"।স্যার কিন্তু বলতে পারতেন যে তিনি চা খান না।কিন্তু সেটা না করে নিজের বহুদিনের অভ্যাস ত্যাগ করেছেন। শুধু আমরা কষ্ট পাবো বলে।

হাজার বছর বেঁচে থাকুন স্যার।আপনাকে বাঁচতেই হবে।আপনি আমাদের মাঝে আলোর প্রদীপ শিখা হয়ে বেঁচে থাকবেন।আল্লাহ আপনাকে সুস্বাস্থ্য দান করুক।💕

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফিচার কী? একটি সুন্দর ফিচার কিভাবে লিখবেন? উপাদান, বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ।

চার কৌশলে সর্বোচ্চ সিজিপিএ, পেলেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক

কবে জুতা মুক্ত হবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার?