কেমন চলছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম?
বিশ্ববিদ্যালয় বলতে সাধারণত এমন এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে বোঝায় যেখানে চর্চা হয় বিশ্বমানের জ্ঞান,বিশ্বজ্ঞান।এই বিচিত্র বহুমুখী প্রতিভা বিকশিত হওয়ার স্থান যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয় তাহলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা নিজেকে বারবার প্রশ্ন করেছি। আমরা এই বিশ্বজ্ঞান অর্জনের পরিবেশ ও প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা পাচ্ছি কিনা। উত্তরে "না" ছাড়া কোন শব্দ আসার সুযোগ নেই।বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের মাননীয় উপাচার্য মহোদয় বলেছিলেন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় হবে "ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটি "।কথাটি এখনও আমার কানে বাজে।একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয় অবকাঠামো, উপকরণ, শিক্ষক ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা না থাকলে সেটা কোন ক্লাসের মধ্যে পড়ে তা বোধগম্য নয়।তবে ওয়ার্ল্ড ক্লাস ইউনিভার্সিটি হয়ে ওঠা যে সম্ভব না এটা নিশ্চিত।
লাইব্রেরী,রিডিংরুম,ল্যাবের প্রয়োজনীয় উপকরণ,ডরমেটরি,কনফারেন্স রুম,সুন্দর খেলার মাঠ, সুইমিংপুল, জিমনেশিয়াম, মসজিদ,টিএসসি, বিশুদ্ধ পানির ফিল্টার,উন্নত চিকিৎসার ব্যবস্থা,কম্পিউটার ল্যাবে ইন্টারনেট সংযোগ,ই-জার্নাল ও ই-লাইব্রেরী ব্যবহার,প্রয়োজনীয় পরিবহন ব্যবস্থা,সরকারি খরচে হলে ইন্টারনেট সংযোগ, হলের রিডিংরুম,গেস্টরুম,ড্রেনেজ ব্যবস্থা প্রভূতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাত বছর হলেও এসবের কিছুই নেই আমাদের।না, থেমে থাকিনি তবুও আমরা তথাকথিত বিশ্বজ্ঞান অর্জন করছি।স্বাধীন মতপ্রকাশের জন্য যেমন সভাস্থল প্রয়োজন,সেমিনার, সিম্পেজিয়াম, মুভি প্রদর্শনী ও আলোচনা সভার জন্য চাই অডিটোরিয়াম।কালচারাল অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য মঞ্চ প্রয়োজন।বিতর্ক চর্চা, নাটক, খেলাধুলা,বিএনসিসি, রোভার স্কাউটের ক্যাম্পিং ও বিভিন্ন প্রতিযোগীতায় আগত অতিথিদের থাকার জন্য ডরমেটরি প্রয়োজন।ছাত্র-শিক্ষকদের মাঝে সুসম্পর্ক ও পারস্পরিক বিনিময়ের জন্য ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র প্রয়োজন।আর এই সবকিছুই উচ্চশিক্ষার জন্য।এই প্রয়োজন সাময়িক নয়, সার্বক্ষণিক প্রয়োজন।কিন্তুু শিক্ষার্থীরা কি পাচ্ছে আর এগুলোর কতটুকুই বা ব্যবহার করছে? মুক্তমঞ্চে অনুষ্ঠানের আয়োজন করলেও শিক্ষার্থীদের টাকা দিতে হয়।
শ্রেনী কক্ষের সল্পতা লেগেই আছে।লোকপ্রশাসন, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান, একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম, ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, হিসাব বিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানসহ বেশ কয়েকটি বিভাগে ৬/৭ টি ব্যাচের জন্য ক্লাসরুম মাত্র একটি।অধিকাংশ ক্ষেত্রে তিনটি ক্লাসরুম দুই বিভাগ ভাগাভাগি করে ক্লাস পরিচালনা করে থাকে।বিকল্প হিসেবে ক্যাফেটেরিয়া ও নির্মানাধীন লাইব্রেরী ভবনেও ক্লাস নেয়া হয়। যার ফলে প্রতিদিন ক্লাস নেয়াও সম্ভব না।
সব সমস্যাকে ছাপিয়ে মহামারী আকার ধারন করেছে সেশন জট।অর্থনীতি বিভাগের ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ সেশনে জট আছে প্রায় দেড় বছর।২০১৩-১৪ সেশনে গণিত, লোকপ্রশাসন, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান, বাংলা বিভাগসহ অধিকাংশ বিভাগের ৮/১০ মাস এবং ২০১৪-১৫ সেশনে রাষ্ট্রবিজ্ঞান, হিসাব বিজ্ঞান, মার্কেটিং, ম্যানেজমেন্ট, ফিজিক্স, ফাইন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং, মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান সহ বেশীর ভাগ ডিপার্টমেন্টই ৬/৭ মাস সেশন জট রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের বিকাশ, স্বপ্নের সম্পূর্ণতা,আলোকস্নাত মুক্তি এবং জ্ঞান আহরণের প্রানকেন্দ্র হল লাইব্রেরী।পর্যাপ্ত বই থাকবে সেখানে,কিন্তুু লাইব্ররীতে বা সেমিনারে প্রয়োজনীয় বই নেই।লাইব্রেরীতে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের বইয়ের সংখ্যা মোট ১৮৬ টি।যার মধ্যে এক বই পাঁচ /দশ কপিও আছে।গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা, বায়োকেমেস্ট্রি ও বায়োটেকনোলজি, কোস্টাল স্টাডিজ এন্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট এবং দর্শন বিভাগে সংখ্যার হিসেবে দশ পনেরটির বেশী বই নেই।কোর্স ভিত্তিক বইয়ের সংখ্যাও কম।রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে এমন অনেক কোর্সও সম্পন্ন করেছি যে কোর্সের কোন বই লাইব্রেরীতে ছিল না, এখনও নেই।ইন্টারনেটের বিভিন্ন আর্টিকেলই ছিল একমাত্র রিসোর্স।সব বিভাগেই কোর্স ভিত্তিক বই পাওয়া দুষ্কর।কেন্দ্রীয় লাইব্ররীতে একত্রিশ হাজার চারশতো ই-জার্নাল ও একলক্ষ বারো হাজার ই- বুক রয়েছে কিন্তু কম্পিউটার ল্যাবে ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় সেগুলো ব্যবহার করতে পারছে না শিক্ষার্থীরা।
বিজ্ঞান অনুষদের ল্যাবেও নেই প্রয়োজনীয় যন্ত্র।পড়ানো হচ্ছে মাইক্রোবায়োলজি অথচ ল্যাবে নেই মাইক্রোস্কোপ।শিক্ষার্থীরা জানেনা কিভাবে মাইক্রোস্কোপ ধরতে হয়।আছে ডিস্টিলেশন প্রোসেস (Distillation Process) যন্ত্র কিন্তু তাও ঠিকভাবে রান হয় না।কয়েকটি বিভাগে ল্যাবে প্রয়োজনীয় যন্ত্র থাকলেও অধিকাংশ বিভাগই ধারদেনা করে ল্যাবের কাজ সম্পন্ন করে।শুনেছি শিক্ষার্থীদের কাছে উদাহরন হিসেবে উপস্থাপন করা হয়, ওমুক একটা মুভিতে দেখেছ এরকম এরকম একটা যন্ত্র? সেটা হচ্ছে এই যন্ত্র।এভাবেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম।
মানসম্মত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামোর পাশাপাশি সর্বাগ্রে দরকার দক্ষ, যোগ্য, নিবেদিতপ্রাণ, আদর্শবান শিক্ষক।বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র -শিক্ষকের অনুপাতে শিক্ষক সল্পতা রয়েছে।৪৪ জন প্রফেসর পোস্টের ৪৩ টি, ৬৬ জন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর পোস্টের ৬৫ টি পোস্ট খালি।২৪১ জন লেকচারার থাকার কথা থাকলেও আছে মাত্র ১৭৩ জন।অর্থাৎ ৪৯% পোস্ট খালি।তারপরেও গতদুই বছর ধরে প্রতিবছর দুটি করে বিভাগ বৃদ্ধি করা হচ্ছে।একজন শিক্ষককে প্রয়োজনের তুলনায় বেশী ক্লাস নিতে হচ্ছে।একজন শিক্ষক ৭/৮ টি করে কোর্স নেন সাথে আরো অনেক ল্যাব পরিচালনা করেন।অনেক বিভাগেরই ব্যাচের তুলনায় শিক্ষকের সংখ্যা কম অর্থাৎ ৩/৪ জন শিক্ষক দ্বারা ৫/৬টি ব্যাচ পরিচালিত হয়।একাউন্টিং এন্ড ইনফরমেশন সিস্টেম বিভাগে ৩ জন শিক্ষক ৬টি ব্যাচ পরিচালনা করছে।শিক্ষক সল্পতা পড়ালেখায় কতটা প্রভাব ফেলছে তা অনুধাবন করা খুবই সহজ।
তরুণ শিক্ষকরা পাঠদানের পূর্ব প্রস্তুতিরও সময় পাচ্ছে না। এটা গুনগত পাঠদান ও সঠিক শিক্ষা গ্রহনের অন্তরায়।শিক্ষার্থীরা তুলনামূলক অযোগ্য হয়ে গড়ে উঠছে।
বাংলাদেশের অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত প্রয়োজনীয় সকল সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে শিক্ষার্থীরা অথচ তাদের সামর্থের বাইরে আদায় করা হচ্ছে ভর্তি ফি তের হাজার পাঁচশো,সেমিস্টার ভর্তি ফি তিনহাজার পাঁচশো, মান উন্নয়ন ফি একহাজার টাকা।সেমিস্টার ফি একদিন দেরিতে জমা দিলে ১ হাজার টাকা জরিমানা।পরিবহন ফি পাঁচশো টাকা।বিভাগ উন্নয়ন ফি, চিকিৎসা ফিসহ নানান ধরনের ফি।নতুন বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়ে তুলনামূলক বেশী টাকা দিয়ে পড়ালেখা করলেও শিক্ষার্থীরা পড়ালেখার প্রয়োজনীয় উপকরণ ও সুষ্ঠু পরিবেশ পাচ্ছে না।এমনটাতো হওয়ার কথা নয়।
২০১৫ সালে আমি যখন রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি হই তখন আমার এক বন্ধু জমি বন্ধক রেখে ভর্তি হওয়ার পর বাড়ি থেকে ৩০০ টাকা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, সে তখনো জানেনা কোথায় থাকবে, কি খাবে, মাসের বাকি দিনগুলি কিভাবে কাটবে।কত অভাব, অনটনে দিন যাপন করলে পড়ালেখার জন্য একজন বিশ্ববিদ্যালেয় শিক্ষার্থী আত্মসম্মান ভুলে বরিশালে অটো রিক্সা চালিয়ে জীবন নির্বাহ করে তা বোঝার সক্ষমতা কি আমাদের আছে? এই যদি হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের এর নমুনা তাহলে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর শিক্ষালাভের অধিকার রাষ্ট্র কিভাবে নিশ্চিত করবে?
দরিদ্র জনগোষ্ঠী থেকে আসা শিক্ষার্থীরা ধার-দেনা করে কিংবা জমিজমা বিক্রি করে ভর্তি ফি-এর ধাক্কাটা হয়তো সামলে নেয়। তারপরও তার সামনে দীর্ঘ পথ বাকি থাকে। প্রতিবার সেমিস্টার ফি, পরীক্ষার ফি, বিভাগ উন্নয়ন ফি, পরিবহন ফি, চিকিৎসা ফি কীভাবে জোগাড় হবে তা অধিকাংশ ছাত্রদেরই তাড়িয়ে বেড়ায়।অাবাসন সংকটের কারনে হলেও স্থান পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা।
এরকম একটা সুবিধা বঞ্চিত বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘বিশ্ববিদ্যা’ অর্জিত হয় না।পড়ালেখা শেষে হয়তো একটি সনদ পাওয়া যাবে, কিন্তু শিক্ষার্থীরা যেভাবে অযোগ্য হয়ে গড়ে উঠছে তা কি দেশের উপকারে আসবে ? একজন দিনমজুর রিকশাওয়ালা, ফেরিওয়ালা, কৃষক, জেলে থেকে শুরু করে একজন ভিক্ষুক পর্যন্ত সর্বস্তরের জনগোষ্ঠীর টাকায় চলে বিশ্ববিদ্যালয়।একজন ভিক্ষুক যখন দশটাকার কেরোসিন ক্রয় করে সেখানেও সে সরকারকে ভ্যাট দেয়।তাই বলতে গেলে আমরা একজন ভিক্ষুকের কাছেও দায়বদ্ধ।সুতরাং জনগণের টাকা দিয়ে পড়ে শেষ পর্যন্ত জনগণের সঙ্গে প্রতারণাই করা হয়।বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সমাজের সর্বস্তরের মানুষের কাছে দায়বদ্ধ।বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সাত বছর পরেও শিক্ষা অর্জনে সহায়ক মৌলিক প্রয়োজনগুলো পূরণে প্রশাসন ব্যর্থ হয়েছে।শিক্ষা উপকরনের অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাত হাজার শিক্ষার্থী অযোগ্য হয়ে গড়ে উঠছে।এ দায় কে নিবে?
যে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রয়োজনীয় ক্লাস রুম, রিডিং নেই, লাইব্রেরীতে বই নেই, ল্যাব সারাঞ্জম নেই, ইন্টারনেট সুবিধা নেই,প্রয়োজনীয় শিক্ষক নেই, ডরমেটরি নেই, হলের ক্যান্টিনে ভর্তুকি নেই, পূর্ণাঙ্গ রিডিং রুম নেই, গেস্টরুম নেই, প্রয়োজনীয় পরিবহন নেই।সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দফতরে আপ্যায়ন ব্যয় বাবদ প্রতি মাসে ২৫ হাজার টাকা করে বিগত ২ বছরের অধিক সময়ে আপ্যায়ন বাবদ ১০ লাখ টাকার বেশি অতিরিক্ত ব্যয় এবং ট্রেজারার ও ভিসি মহোদয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাড়া করা বাসায় থাকার পরেও
গত প্রায় ৩ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসা ভাড়া পরিশোধ বাবদ ববির অতিরিক্ত প্রায় ৮ লাখ টাকার আর্থিক ক্ষতির অভিযোগ আমাদেরকে সত্যিই ভাবিয়ে তোলে।কিন্তু এসব নিয়ে আমাদের কেন ভাবতে হচ্ছে? আমরা ভাবতে চাই দেশকে নিয়ে, দেশের মানুষকে নিয়ে, নিজেদের শ্রেষ্ঠ প্রমান করে কিভাবে বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশকে উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা যায়, কিভাবে বাঙালী জাতি বিশ্ব দরবারে মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় দিগন্ত ব্যাপী আলো ছাড়াবে।শিক্ষা আমাদের অধিকার।বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ে সিংহভাগ শিক্ষার্থীর শিক্ষার অধিকার মারাত্মকভাবে সংকুচিত হচ্ছে।এভাবে চলতে থাকলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় অদূর ভবিষ্যতে একটি নাম সর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিনত হবে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন