৬৪ জেলা ভ্রমন করা হার না মানা সাইক্লিস্টের গল্প

"স্বপ্নে সোনার বাংলাদেশ"

মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। অদম্য  ইচ্ছা শক্তি আর সাহসীকতা থাকলে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতাও জয় করা যায়। তখন সফলতা হাতছানি দিয়ে ডাকে।

বাবা সাইকেলের মেকানিক ওখান থেকেই সাইকেলের প্রতি ভালোবাসা সাব্বিরের, ছোটবেলা থেকেই একটি ভালো ব্র্যান্ডের সাইকেল কেনার শখ ছিলো কিন্তু টাকার অভাবে হয়ে উঠেনি। বড় ভাই সাগর হোসেন অষ্টম শ্রেণির বৃত্তির টাকা দিয়ে একটি পুরাতন সাইকেল কিনলে তার হাত ধরেই সাইকেল শেখা। এরপর বড় ভাই বাড়িতে না থাকলেই বেরিয়ে পড়তেন সাইকেল নিয়ে। কখনো দশ-বিশ কিলোমিটার দূরে আত্মীয়ের বাসায়, কখনোবা পার্শবর্তী গ্রামে।

ছোট বেলা থেকেই ভ্রমণ কাহিনী পছন্দ করতেন, পছন্দের তালিকায় স্থান পেতো ভ্রমণ প্রকৃতির বই। ইবনে বতুতা তার জীবনে বিশেষ স্থান দখল করে আছে। ছোটবেলায় তাদের গ্রামে এক বিদেশী পর্যটক ঘুরতে এসে  জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাংলাদেশ আসলে দেখতে কেমন?’ গ্রামের একজন বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ দেখতে এই গ্রামের মতোই।’ ভ্রমন পিপাসু সাব্বিরের কৌতূহলের পালে নতুন করে হাওয়া বইতে শুরু করে। মনে মনে স্বপ্ন বুনেন নিজ সাইকেলেই বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় ভ্রমন করবেন। সুযোগ পেলে ইবনে বতুতার মত চষে বেড়াবেন বিশ্বব্যাপী।প্রকৃতি যেন সবসময়ই  তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকতো।

দারিদ্র্য আর পারিবারিক অসচ্ছলতার কাছে হার না মানা সাব্বিরের বাংলাদেশ ভ্রমনের স্বপ্নটা সত্যি হওয়া শুরু করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের মত্স্যবিজ্ঞান অনুষদে ভর্তি হওয়ার দেড় বছর পর। যোগাযোগ করার জন্য একটা মোবাইল কিনে দেয়ার সামর্থ্যও ছিল তার পরিবারের।মোবাইলের প্রতিও সাব্বিরের তেমন ঝোঁক ছিল না। টার্গেটই ছিলো ভালো একটা সাইকেল কেনার। ভার্সিটি জীবনের প্রায় দেড় বছর যাওয়ার পর অনেক কষ্টে বড় ও ছোট বোনের দশ হাজার টাকা, ছোট ভাইয়ের পাঁচশো টাকা ও  মা-বাবার জমানো কিছু টাকা মিলিয়ে কিনে ফেলেন নতুন একটা সাইকেল।

প্রথম জেলা হিসেবে মাগুরা দিয়ে ২০১৭ সালে ভ্রমন শুরু করেন। ৬৪ তম জেলা হিসেবে ২০১৮ সালের ১৮ অক্টোবর কক্সবাজারে এসে শেষ হয় স্বপ্নের সোনার বাংলা ভ্রমন। এসময় তার সাইকেলের সামনে প্ল্যাকার্ডে লেখা ছিল ‘রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নাও’ আর  মাঝ খানে "স্বপ্নে সোনার বাংলাদেশ"।

সাব্বির হোসেন বলেন, ''প্রথম দিকে ১০-১৫ জেলা ঘোরার পর হঠাৎ আমার মনে হলো বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমরা সমাজের কাছে দায়বদ্ধ।তাই দেশের বিভিন্ন অসঙ্গতি নিয়ে সাইকেলের সামনে বিভিন্ন সচেতনতামূলক প্ল্যাকার্ড লাগালে মানুষজনকে সচেতন করা যাবে।এই ভাবনা থেকেই আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন সমস্যা ও অসঙ্গতির প্ল্যাকার্ড  সাইকেলের সামনে লাগিয়ে ঘুরতাম।" এসব প্ল্যাকার্ডের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ‘নিরাপদ সড়ক চাই’, 'কোটা সংস্কার করুন', ‘রোহিঙ্গা গণহত্যার বিচার চাই’, ‘ধর্ষণকে না বলুন’, ‘পরিবেশদূষণ রোধ করি’, 'গাছ লাগান',  ,'বাল্য বিবাহকে না বলুন' ইত্যাদি।প্রতিবার ভ্রমণের সময় এমন সব জনসচেতনতামূলক লিফলেট ছড়িয়ে দিয়েছেন দেশের বিভিন্নস্তরের মানুষের মাঝে।

তার এই ৬৪ জেলা ভ্রমনে সাক্ষাৎ করেছেন অনেক গুনী মানুষের সাথে।দেখা করেছেন ভাষা শহীদ আব্দুল জব্বারের  পরিবারের সহ বিভিন্ন শহীদদের পরিবারের সাথে। সাক্ষাৎ করেছেন এভারেস্ট জয়ী মূসা ইব্রাহীমের সাথে, বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের তারকা নড়াইল এক্সপ্রেস মাশরাফি বিন মর্তুজার সাথে।তার সাথে সাক্ষাৎ হওয়ার পর অনেকই সাব্বিরকে ঝিনাইদহ এক্সপ্রেস বলে ডাকতে শুরু করেছে।

দীর্ঘ পথচলায় সাব্বিরকে প্রতিদিন সংগ্রাম করতে হয়েছে দারিদ্র্যের সাথে।মুখোমুখি হয়েছেন অনেক সমস্যার, বিশেষ করে অর্থে অভাবটা অনুভব করেছেন প্রতি মুহূর্তে।বিভিন্ন জেলায় গিয়ে হোটেলে থাকার মত  টাকা না থাকায় চায়ের দোকানে, খাবার হোটেলে রাত কাটিয়েছেন। কখনো সকালে  না খেয়ে আবার মাঝে মাঝে  রাতে না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়তেন।তবুও থেমে থাকেনি তার সাইকেলের চাকা ।

বাংলাদেশের বুকজুড়ে ছোটাছুটির পর এবার  গোটা পৃথিবীটা চক্কর দেওয়ার পরিকল্পনা মাথায় নিয়েছেন সাব্বির হোসেন।আর্থিক সহায়তা পেলে যথারীতি সাইকেলে করেই ভ্রমন করতে চান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া প্রথম দেশ ভুটানে।

প্রথমদিকে শখের বশে ভ্রমণ শুরু করলেও এখন সাব্বির অনুভব করেন, তিনি তার ভ্রমণের মাধ্যমে নিজ দেশের মানুষকে সমাজের বিভিন্ন অসঙ্গতি সম্পর্কে সচেতন করতে পারছেন। সেটা তাকে বেশ আনন্দ দেয়।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ফিচার কী? একটি সুন্দর ফিচার কিভাবে লিখবেন? উপাদান, বৈশিষ্ট্য, বিষয়বস্তু ।

চার কৌশলে সর্বোচ্চ সিজিপিএ, পেলেন প্রধানমন্ত্রী স্বর্ণপদক

কবে জুতা মুক্ত হবে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনার?