জামাল খাশোগী অপহরণ: নেপথ্যে কারা?
খাশুগজীর অপহরণ: নেপথ্যে কারা?
আরব বসন্তের পর থেকে এমনিতেই তুর্কী সৌদী সম্পর্ক ধুঁকে ধুঁকে চলছে। বাদশাহ সালমান ক্ষমতা নেয়ার পর কিছু দিন দু'দেশের সম্পর্কে সুবাতাস বইলেও খুব দ্রুতই তা মিলিয়ে যায়। বরং বলা যায়, পূর্বের চেয়েও তা আরও বেশী অবনতীর দিকে যায়। সর্বশেষ কাতার ট্র্যাজেডীর পর তো এক রকম দা-কুমড়োর সম্পর্কের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে। তবে, পরষ্পরের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চললেও কূটনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সম্পর্ক অটুট রাখার ব্যাপারে দু'দেশ বরাবরই সতর্ক থেকেছে।বিশেষত তুরষ্ক এক্ষেত্রে খুব পেশাদারীত্বের পরিচয় দিয়েছে। রাজনৈতিকভাবে তো নয়ই; মিডিয়ার মাধ্যমেও সৌদী আরবকে তেমন আক্রমনের নিশানা বানায়নি, যেমনটা সাধারণত মিশর এবং আরব আমিরাতের ক্ষেত্রে করে থাকে। সৌদী আরবও রাজনৈতিক বক্তব্যে হুঁশিয়ার ছিল। কিন্তু কূটনৈতিকভাবে এবং মিডিয়ার মাধ্যমে তুরষ্ককে ধরাশায়ী করার প্রচেষ্টা সবসময় অব্যাহত রেখেছে। কিন্তু এই ক্ষীণ ভারসাম্যটুকুও মনে হয় আর টিকে থাকছে না। অনুমান বলছে, দুই দেশের সম্পর্ক স্মরণকালের সবচেয়ে কঠিন সংকটের মুখোমুখী হতে যাচ্ছে। এবারের নতুন ঘটনা প্রসিদ্ধ সৌদী সাংবাদিক জামাল খাশুগজীর কিডন্যাপ এবং সম্ভাব্য হত্যাকান্ড।
#এক.
জামাল খাশুগজী (খাসুকজী), একজন প্রসিদ্ধ সৌদী সাংবাদিক। ১৯৫৮/৫৯ ইংরেজীতে মদীনা মুনাওয়ারায় জন্মগ্রহন করেন। তিনি বংশগতভাবে তুর্কী বংশোদ্ভুত। প্রায় ৫০০ বছর পূর্বে উসমানী আমলে তাদের পরিবার আরবে আসে। এর পর স্থায়ীভাবে মদীনায় বসবাস শুরু করে। খাশুগজী সৌদী আরবে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করার পর আমেরিকার ইন্ডিয়ানা স্ট্যাট ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন করেন। তারপর সৌদী আরব ফিরে এসে ১৯৮৭ সালে সাংবাদাকিতার সাথে স্থায়ীভাবে যুক্ত হন। আফগান যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধসহ ৮০ এবং ৯০ এর দশকের বড় বড় ঘটনাগুলো দক্ষতার সাথে কভার করে লাইমলাইটে আসেন। খ্যাতির পাশাপাশি তার পেশাদারীত্ব এবং প্রতিভা মিডিয়া জগতে তার দ্রুত এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হয়। ১৯৯৯ থেকে নিয়ে ২০০৩ পর্যন্ত সৌদী পত্রিকা 'আরব নিউজের' সহকারী সম্পাদকের দায়ীত্ব পালন করেন। ২০০৩ এর শেষের দিকে এসে প্রসিদ্ধ সৌদী পত্রিকা 'দৈনিক আল ওয়াতানে'র প্রধান সম্পাদকের দায়ীত্ব পান। ২০০৪ থেকে ২০১০ পর্যন্ত এই দীর্ঘ সময়ে সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাবেক সৌদী গোয়েন্দা প্রধান প্রিন্স তুর্কী আল ফয়সালের তথ্য-উপদেষ্ঠা হিসেবে দায়ীত্ব পালন করেন। সে-সময় তুর্কী আল ফয়সাল ওয়াশিংটন এবং পরে লন্ডনে সৌদী রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়ীত্ব পালন করছিলেন। এছাড়াও লন্ডনের 'আল হায়াত'সহ পৃথিবীর বহু নামীদামী দৈনিক এবং ম্যাগাজিনে নিয়মিত লিখতেন। তিনি তার লেখায় সৌদী আরবের কিছু কিছু পদক্ষেপের মৃদু সমালোচনা করতেন। সে জন্য তাকে বহু ঝামেলার সম্মুখীন হতে হয়েছে। আল ওয়াতানের সম্পাদকের পদ থেকে অব্যহতি দেয়া হয়। সৌদী মালিকানাধীন লন্ডনের আল হায়াত পত্রিকায় তার লেখা নিষিদ্ধ করা হয়। তবুও তিনি বলতেন যে, আমি সৌদ বংশের কল্যাণ চাই। আমি আমার দেশকে ভালোবাসী। যা কিছু বলি তা একান্তই দেশপ্রেম থেকে বলি। তিনি ডঃ মিসআরী বা গানেম আল দাওসারীর মতো ঘোষণা দিয়ে সৌদী শাষণের বিরোধী পক্ষে যোগ দেননি। তিনি এটা বরাবারই বলতেন যে, আমি বিরোধী পক্ষ নই। আলে সৌদকে ভালোবাসী। তাদের কল্যাণ কামনা করি। মুহাম্মাদ বিন সালমান যখন প্রথম প্রথম সংস্কার মূলক বিভিন্ন পদক্ষেপ নিচ্ছিলেন তখন তিনি তাতে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তিতে নেয়া ইবনে সালমানের বেশ কিছু পদক্ষেপের তিনি সমালোচনা করেন। তার মধ্যে কাতারের বিরুদ্ধে অবরোধ এবং ইয়েমেনে আগ্রাসন ছিল অন্যতম। তার পর থেকে সৌদী রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে তার দূরত্ব তৈরি হতে থাকে। ২০১৬ এর শেষের দিকে এসে যখন সৌদী আরব ভিন্নমতাবলম্বীদের উপর নিপীড়ন চালাতে শুরু করে তখন তিনি সৌদী আরব ছেড়ে আমেরিকায় পাড়ি জমান। সেখানে গিয়ে তিনি তার কর্মমুখর জীবনে আরো বেশী গতি খুঁজে পান। আমেরিকান মিডিয়ায় নিয়মিত সরব থাকেন। আমেরিকায় পড়াশোনা এবং পূর্বে ওয়াশিংটনে সৌদী রাষ্ট্রদূতের উপদেষ্ঠা হিসেবে কর্মরত থাকার সুবাদে মার্কিন রাজনীতি এবং ডিপ স্টেটের উপরের তবকার সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল তার। এটাকে কাজে লাগিয়ে তিনি দ্রুত মার্কিন মিডিয়ায় জায়গা করে নেন। প্রায় প্রত্যেকটি প্রভাবশালী পত্রিকায় লিখতেন। বিভিন্ন সিম্পোজিয়াম টকশোতে নিয়মিত অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষত, ওয়াশিংটন পোষ্টে ধারাবাহিকভাবে লিখতেন। ওয়াশিংটন পোষ্টে তার জন্য একটি কলাম বরাদ্ধ ছিল। সাংবাদিক হিসেবে তিনি আপাদমস্তক একজন পেশাদার সাংবাদিক ছিলেন। ব্যাক্তিগত আক্রোশ বা ক্ষোভের জায়গা থেকে কখনো সৌদী পলিসির সমালোচনা করতেন না। নিখাদ দরদ নিয়ে নিষ্ঠার সাথে যা বলার বলতেন। তিনি নিজেই বলতেন, আমার মাথার উপর বাদশাহর বাইয়াত আছে। আমি আমার দেশকে, দেশের সরকারকে ভালোবাসি। এই ভালোবাসার কারণেই শাসক পরিবারের কল্যান কামনা করি। আমার সমালোচনাও এই ভালোবাসার জায়গা থেকে। তার এমন ভারসাম্যপূর্ন চিন্তাধারার কারণেই আমেরিকান মিডিয়া তাকে খুব গুরুত্বের সাথে নিতো।
এর মধ্যে সৌদী প্রশাসনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাক্তি তার সাথে যোগাযোগ করতেন এবং দেশে ফিরে আসতে অনুরোধ করতেন। ওয়াশিংটনে সৌদী রাষ্ট্রদূত বাদশাহ সালমানের ছেলে প্রিন্স খালিদ বিন সালমানের সাথেও ভালো সম্পর্ক ছিল। এম্ব্যাসীতে গেলে বেশ সম্মানের সাথেই তার সাথে ব্যাবহার করা হতো। কিন্তু তবুও তিনি দেশে ফিরতে ভয় পাচ্ছিলেন। এর মধ্যে তার বিবির সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ হয়। পরবর্তীতে তুরষ্কের একজন পিএইচডি গবেষক খাদীজা সেঙ্গিস নামে এক রমনীর সাথে তার বিবাহের কথা পাকাপাকী হয়। বিয়ে করার জন্য তিনি সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে তুরষ্ক যান। তুর্কী আইন অনুযায়ী বিবাহের কাজ সম্পাদন করার জন্য তুরষ্কে অবস্থিত সৌদী দূতাবাস থেকে কিছু ডকুমেন্ট সত্যায়ণ করার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। তাই তিনি ইস্তাম্বুলের সৌদী কনস্যুলেটে যান। কনস্যুলেটে তাকে সম্মানের সাথে অভ্যর্থনা জানানো হয়। তবে, বলা হয় যে, আপনার কাগজগুলো এখন দেয়া সম্ভব হবে না। অক্টোবরের ২ তারীখ দুপুরের দিকে আসতে হবে। কী আর করা, অপেক্ষার প্রহর শেষ হওয়ার পর অক্টোবরের ২ তারীখে দুপুর একটার দিকে তিনি তার হবু স্ত্রীকে নিয়ে কনস্যুলেটে যান। পূর্বের বার কনস্যুলেটের কর্মকর্তাদের উষ্ন ব্যাবহার দেখার পর আর তার মাথায় কোন নেগেটিভ চিন্তা আসেনি। এক রকম নির্ভয়েই গেলেন। গেইটে ঢুকার মুহুর্তে তার হবু স্ত্রীকে আটকে দেয়া হয়। বলা হয় যে, উনার ঢুকার অনুমতি নেই, আপনি একাই আসুন। এটা দেখে সম্ভবত তিনি কিছুটা আঁচ করেছিলেন। তিনি খাদীজার হাতে তার মোবাইল দিয়ে বলেন, যদি আমার ফিরতে দেরী হয় তাহলে তুমি প্রেসিডেন্ট এরদোগানের উপদেষ্ঠা ইয়াসিন আকতায়ীর সাথে যোগাযোগ করো। আকতায়ীর সাথে খাশুকগীর পূর্ব বন্ধুত্ব ছিল। এই বলে তিনি ঢুকলেন, কিন্তু আর বের হলেন না। তার হবু স্ত্রী ৩/৪ ঘন্টা অপেক্ষা করার পরেও যখন দেখলেন যে, তিনি ফিরছেন না তখন পুলিশকে এবং উপদেষ্ঠা ইয়াসিন আকতায়ীকে ফোন করেন। সাথে সাথে পুলিশ এবং গোয়েন্দারা এমব্যাসীর পাশে অবস্থান নেয়। প্রয়োজনী পদক্ষেপ নেয়। সময় গড়িয়ে যায়, কিন্তু খাশুকগী আর বের হয়নি। আজ ৭ দিন হয়ে গেল, এখনো পর্যন্ত তিনি নিখোঁজ।
এটা হচ্ছে খাশুকগীর পরিচয় এবং ঘটে যাওয়া ঘটনা।
এই ঘটনা আর দশটি কিডন্যাপের ঘটনার মতো নয়। এটা গোটা দুনিয়াকে নাড়িয়ে দিয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে আরব বিশ্বের এবং পশ্চিমা বিশ্বের তাবৎ মিডিয়া এই ঘটনা নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। সৌদী আরবে তো ভিন্নমতাবলম্বীদেরকে এমনিতেই জেল-জুলুমের উপর রাখা হয়। কিন্তু এই ঘটনা সেগুলো থেকে ভিন্ন। তার অনেকগুলো কারণের মধ্যে কয়েকটি হচ্ছে --
১.খাশুগজীর সাথে আমেরিকা ইউরোপের প্রভাবশালী মানুষদের সম্পর্ক আছে। লিনডসে গ্রাহামের মতো প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটরের সাথে খাতির আছে তার। ডেভিড ফ্রেডম্যানের মতো বিখ্যাত আমেরিকান ব্যাক্তিত্ব তার বন্ধু।
২. তিনি একজন প্রসিদ্ধ সাংবাদিক। এই কারণে তার উপর যেকোন আক্রমনকে একজন ভিন্নমতের সাংবাদিকের উপর আক্রমন হিসেবে দেখা হচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বে এই ব্যাপারটি অনেক সেনসেটিভ। তার উপর তিনি ওয়াশিংটন পোষ্টের মতো পত্রিকার নিয়মিত লেখক। নিউ ইয়র্ক টাইমসেও লেখেন। তাই পশ্চিমা মিডিয়া ব্যাপারটিকে খুব গুরুত্বের সাথে নিয়েছে। তাকে কিডন্যাপ করার প্রতিবাদ স্বরুপ ওয়াশিংটন পোষ্টে একদিন একটি কলাম শূন্য রাখা হয়েছে। প্রতিদিন জোরালোভাবে সংবাদটি প্রচার করা হচ্ছে এবং মার্কিন সরকারকে আহবান করছে যথাযথা পদক্ষেপ নেয়ার জন্য।
৩. তাকে কিডন্যাপ করা হয়েছে একটি ভিন্ন দেশে অবস্থিত সৌদি আরবের দূতাবাসে। দূতাবাসের মতো এমন সেনসেটিভ জায়গায় কিডন্যাপ করার ঘটনা অকল্পনীয়। এর মাধ্যমে গোটা দুনিয়ার স্বীকৃত কূটনৈতিক নিয়মকেই বৃদ্ধাঙুলী দেখানো হয়েছে। যদি এই ঘটনার পেছনে সৌদী আরবের জড়িত থাকাটা প্রমানিত হয় তাহলে দেশটিকে চরম মূল্য দিতে হবে। এমনকি এর কারণে সৌদী রাজতন্ত্রের খুঁটিও এদিক সেদিক হয়ে যেতে পারে।
#দুই.
প্রশ্ন হচ্ছে এই ঘটনার নেপথ্যে কারা? এতো বড়ো ঘটনা তো নিশ্চয় কোন কাঁচা হাতের কাজ নয়। সম্ভাব্য পক্ষগুলো এরকম হতে পারে --
১. তুরষ্ক নিজেই করতে পারে। কারণ তুর্কী সৌদী সম্পর্ক ভালো যাচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যের প্রায় সব জায়গায় সৌদী আরব আমিরাতী আর ইসরাইলী লবির সহযোগীতায় তুরষ্কের পথে বাধা সৃষ্টি করে চলেছে। সম্প্রতী দেশটি ঘোষণা দিয়েছে যে, তারা সিরিয়ার কুর্দীদেরকে সাহায্য করবে। এটা তারা আগেও করেছে। কুর্দী ইস্যু হচ্ছে তুরষ্কের জন্য জীবন মরণ একটা ইস্যু। এই সুতায় যে টান দিবে তাকে তুরষ্ক ক্ষমা করতে পারবে না। তাই সৌদী আরবকে শায়েস্তা করতে এরকম একটি ঘটনা ফেঁদে সৌদীকে ট্র্যাকে ফেলার সম্ভাবনা থেকেই যায়।
তথ্যসূত্রঃ কায়রো বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি গবেষক,মোহাম্মদ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন